সময়ের গদ্যরূপ

‘কবিতা’ একটি ধারণা, যার আঁতুরঘর স্কুল। লেবেল তখনই মগজে সেঁটে যায়। যাঁরা পরবর্তীতে কবিতাচর্চার মধ্যে থাকেন না তাঁদের মগজের কারফিউ আর ওঠে না। তাঁরা বৃদ্ধবয়সেও মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন ও বড়জোর জীবনানন্দের গোটা চারেক আওড়ান। কবিতার ধারণা পালটাতে হলে, নিজেকে ক্রমাগত রিনিউ করে যেতে হয়, পুরোনোকে পেরিয়ে যেতে হয়।

যা লেখা শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষায় তিনের দশকে, কবিতার সে রূপকে, গদ্য কবিতাকে কবিতা বলে মেনে নিতে আমাদের কুড়ি বছর লেগে যায়। জীবনানন্দের সমসময়ে আমাদের মুগ্ধতা ঝুঁকে পড়ে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তদের দিকে। আজও অনেক কবিতা পাঠকের প্যারাগ্রাফে লেখা কবিতা হজম করতে কষ্ট হয়। অথচ প্রায় দুশো বছর আগে বঙ্কিমচন্দ্র প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, কবিতা গদ্যে লেখা হবে না কেন। এক লিটল ম্যাগাজিন মেলার রাতের আড্ডায় একজন তরুণ কবিকে তাঁর প্রিয় কবিদের নাম জিজ্ঞেস করায় তিনি দুটি নাম করেছিলেন, উৎপলকুমার বসু ও শ্রীজাত। উৎপলকুমার বসুর কথায় মনে পড়ল এই কবি সম্পর্কে নানা প্রচার আছে, যার একটি, তিনি ফাঁকিবাজির কবিতা লেখেন। এজন্যে তাঁর মৃত্যুর পর ‘দাহপত্র’ তাঁকে নিয়ে যে ক্রোড়পত্র করে, সেখানে তাঁর এক একটি কবিতার তিন থেকে আটটি খসড়া ছাপা হয়েছিল শুধু এটুকু জানাতে যে, এই কবি ফাঁকি দিয়ে কবিতা লেখেননি।

আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, এই সময়ের কবিতা আলোচনার বিষয় নয়। এজন্যে ‘দাহপত্র’-য় কবিতার আলোচনা থাকে না। আর বিশ্বাস করি কবিতার অংশবিশেষ বলে কিছু হয় না। বাপ-মা তোলার মতো যাঁরা কবিতার অংশ তুলে কথা বলেন তাঁরা কবিতাক্ষেত্রে যত কম থাকেন ততই কবিতার জন্যে স্বাস্থ্যকর। কবি যদি ওই অংশটুকুতে নিজেকে প্রকাশ করতে পারতেন তাহলে পুরো কবিতাটি লিখতেন না। আমি মনে করি কবিতা উদ্ধার করতে হলে কবিতার নাম থেকে শুরু করে প্রতিটি দাঁড়ি, কমা, হাইফেন, স্পেসসহ সম্পূর্ণ কবিতা উদ্ধার করা উচিত, অন্যথায় একযোগে কবি, কবিতা ও কবিতার পাঠককে অপমান করা হয়।

আরেকটি ব্যাপার লক্ষ করে প্রভূত মজা পাই, তা হলো কবিতার সঙ্গে ব্যক্তি-কবিকে গুলিয়ে ফেলা। ধরা যাক আমি বামপন্থী রাজনীতির সমর্থক এবং আমার প্রিয় কবিও তাই। একদিন আমার প্রিয় কবি দক্ষিণপন্থী হয়ে গেলেন, এবং তারপর থেকে তাঁর কবিতা আমার ‘পছন্দ না’ হতে শুরু করল। এমনও হয়, একজন কবি সবসময় নিরপেক্ষ অবস্থান নেন ও তাঁর সততা প্রশ্নহীন। এই ভাবমূর্তি ক্রমে তাঁর কবিতার পাঠকের উপরে পড়তে শুরু করল এবং তিনি যা-ই লেখেন তা-ই ‘আহা!…আহা!’ লাগতে লাগল। অর্থাৎ টেক্সট আর মুখ্য রইল না। এমন এক কবির অতি খাজা লেখা বছরের পর বছর প্রতিটি বাণিজ্যিক কাগজে ও লিটল ম্যাগাজিনের একেবারে প্রথমে ছাপা হতে দেখেছি। এঁরা কবিতা নয়, কবিকে ছাপেন।

ব্যক্তিগতভাবে আমি কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা বিষয়ের উপরে বই পড়তে ভালোবাসি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেসব কবিতা পড়ি তার বেশিরভাগই পছন্দ হয় না। কখনো-সখনো ‘দেশ’ পত্রিকার কবিতা বিভাগে চোখ বোলাই ও নিশ্চিত হই যে, এসব কবিতার নিরানব্বই শতাংশ ‘দাহপত্র’-য় এলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষিপ্ত হত। দাদা-দিদি ধরে কবি হতে চাওয়া, মঞ্চে উঠতে চাওয়া, পুরস্কার পেতে চাওয়া জনপিণ্ড সবসময়ে ছিল, আছে, থাকবে। এদের দেখে করুণা হয়। ‘দাহপত্র’-র সবসময় যে সমস্যা তা হলো পছন্দসই কবিতা খুব কম পাওয়া যায়। এজন্যে একসময় কাগজ বন্ধ করে দেবার কথাও ভেবেছিলাম।

কমলকুমার দত্ত