জীবন
উৎসর্গ: পরেশ ধর
অন্ধকার পেরিয়ে আমি ক্রমশ সরে যাই শান্ত নদীটির কাছে,
শান্ত নদীটির পাশে এক নির্জন চায়ের দোকান
পুরোনো দিন, পুরোনো গল্পগুজব, কবিতার ছিন্নপঙ্ক্তি।
কেউ নেই এখন, শুধু ছন্নছাড়া পিছুটান,
মুঠো খুলে উড়ে যায় প্রজাপতি।
অন্ধকার পেরিয়ে আমি এখন আলোর দিকে সরে যেতে চাই—
তোমার বিষণ্ণ মুখের ওপর সূর্যাস্তের আলো,
শান্ত নদীর নিরভিমান জল ছুঁয়ে যাচ্ছে তোমার পায়ের পাতা।
ছন্দোবন্ধনে ধরা পড়েছে অধরা মাধুরী,
ছলকে উঠছে জীবন।
অনুপস্থিতি
উৎসর্গ: নবনীতা সেন
কালো দিন পেরিয়ে আবার এসে দাঁড়ালাম তোমার ঠান্ডা উঠোনে,
বৃষ্টি ধরে গেছে আগেই, এখন বৃষ্টিশেষের শীতলতা।
তোমার প্রিয় তরুণ কবিরা আজ কেউ নেই,
শুধু কয়েকজন বন্ধু, স্বপ্ন-সহচর আর তোমার আত্মজা আর
এক অনিবার্য অনুপস্থিতি।
স্যাঁতসেঁতে ঘর, উঠোন, সাদা-কালো ছবি সর্বত্রই তুমি জীবন্ত
তোমার না থাকার সত্যিটা আমরা উড়িয়ে দিয়েছি সান্ধ্য-হাওয়ায়।
সিঙাড়ায় কামড় দিতে দিতে আমরা আলোচনা করছিলুম,
কী করে আবার গুছিয়ে তোলা যায় ঈষৎ তোবড়ানো তোমার স্বপ্ন।
ফিরে আসার সময় দেখলাম, মেঘ ফাটিয়ে চাঁদ উঠেছে।
মনে হলো, তুমি হাসছ আর প্রতিবারের মতো বলছ,
আবার আসবেন অরণিদা।
তাকে জাগিও না
হইচই, কোলাহল, তুমুল বাকবিতণ্ডা আর অস্ত্রের দাপাদাপি এড়িয়ে
যে শিশু এক পেট খিদে নিয়ে একা একা ঘুমিয়ে পড়েছে
তাকে জাগিও না।
সে হয়তো স্বপ্ন দেখছে গরম ভাতের,
আরও ক’টা বাচ্চাকাচ্চা জুটিয়ে
সে হয়তো স্বপ্নে খোলা মাঠে লাল বেলুন নিয়ে খেলা করছে—
তাকে জাগিও না।
জেগে উঠলেই তাকে এক ভয়ংকর নরকের মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে,
যেখানে শুধু হিংসা আর লোভ কথা বলে।
গলি
গলির ভিতর দিয়ে হাঁটছি, প্রাচীন, শান্ত, প্রায়ান্ধকার গলি।
খোলা জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে টিভি সিরিয়ালের
সংলাপ ভেসে আসে,
পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে কয়েকটা মুখোশ চলে যায়।
গলির মুখে এসে একবার দাঁড়াই। চারপাশ দেখি।
সেই একজন ভাবছে পৃথিবীর ঝাঁপ খোলা রাখবে না।
বন্ধ করে দেবে।
আমি ভাবছি সমুদ্রের কথা।
কত ঢেউ। অগণন। অনিবার।
গলি থেকে বেরিয়ে আরেক গলি, তারও পরে
অন্য এক গলি।
গলি দিয়ে মোড়া আমাদের জনপদ।
গলির ভিতর দিয়ে হাঁটছি।
হাঁটতে হাঁটতে ইদানীং নিজের নাম, বাড়ির ঠিকানা,
দরজার রং ভুল হয়ে যায়।
ক্ষত
শেষরাতের শূন্যপ্রায় সরাইখানায় নিঃসঙ্গ পথিকের
মুখোমুখি বসে আছি।
আছড়ে পড়ে ঢেউ, আকাশে কোজাগরী,
একটা একটা করে আলো নিভে আসে।
চেয়ার উঠে পড়ে টেবিলের ওপর।
আমরা দুজন বসে আছি মুখোমুখি, অপরিচিত, শব্দহীন—
রাত্রি গড়িয়ে চলে আরও তমসার দিকে।
পথিক তুমি কি পথ হারিয়েছ?
সরাইখানার বাইরে বেরিয়ে আসি নিরুত্তর পথিক আর আমি।
ভাবি, পথিক কেন বারবার হারিয়ে ফেলে পথ—
ভাবি, পথও কেন বারবার হারিয়ে ফেলে পথিককে।
প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com