লেখকের শবযাত্রা

বলো হরি হরিবোল, ঈদৃশ ধ্বনি তুলে, খাটে শুয়ে অপসৃত মৃতদেহ, তারা চলে গেলে, খেয়াল করিনি যে, পাখি উড়ে গেল, পড়ে রইল শূন্য খাঁচা, কেননা এ বিজনে চুলকোতে ভারী মজা, ফুরফুরে যুবতীর আর তার ঝকঝকে মা’র দিকে চেয়ে। তবুও অবদমনের ইনভার্সে, বাড়ি ফিরে যেহেতু খাঁ-খাঁ, পড়া আছে, পাঠ আছে—আত্মহত্যার প্রলোভন থেকে তোমাকে যতটা দূরে রাখে আত্ম-মৈথুনের রশি, তারও বেশি, এই পাঠ—তাই তুমি বাঁচলে— এ যাত্রা, এখনও পড়া আছে বলে, লেখা আছে, তাই। তো আজই আসে ডাকে, গরম গরম, ওপারের দাদা-টির ভাষ এপারের ‘অপর’-এর হাত ঘুরে, চটে গেছে রং, তা-হোক, বাসি ফুলের হলেও তো মালা—অধিকন্তু, পচা পান্তাভাত-ই যার কদাচিৎ জোটে, হলোই বা শুকনো যত খুশি কিসমিস।

তখন বিকেলে, এক-দুটি বুলবুলি আর ক’টি ফিঙে আসে, যেহেতু তার ছেলেবেলার বেতফলের স্বাদ ইহাতেই প্রকটিত হয়, এক অকৃত্রিম দুঃখবিলাসে, এবং এ সূত্র ধরেই যেহেতু, চ্যাং মাছের হিলহিলে, হাত থেকে হড়কে পড়ে যাওয়া, তার মনে যৌন অনুষঙ্গ নিয়ে আসে—মস্তিষ্ক আবিষ্ট হয়, এবং তখন রলাঁ জন্ম লগ্ন। এইরূপ মস্তিষ্ক সঞ্চালনে অভিনিবেশে বিঘ্ন ঘটে নিশ্চয়, কিন্তু ইহা তাহার মুদ্রাদোষ। সে বলে, চলো যাই ফরাসি কাফেতে, কফিতে চুমুক দিয়ে জেনে নিই গবাদি ইতিহাস (বন্ধুবর বলেছিল, ‘গঠনবাদী’-কে সংক্ষেপে ‘গবাদি’ বলা ভালো, স্থান-কাল উভয়ই বাঁচে), নিদেন, তাদের সামাজিক প্রেক্ষিতে, সীন‌্ নদী, লাল মদ—শ্বশুরের টুকিটাকি, চিহ্ন-চিহ্ন খেলা, চিহ্ন নিয়ে হাঁটাচলা, একই মুদ্রার দু-পিঠে দোলে দ্যোতক-দ্যোতিত, চাতক-চাতকী। তারপর, পপকর্ন চিবোতে চিবোতে, এসে পড়ে লেখকের মৃত্যু—মৃত্যুর কারণ, যদিচ তার কলমের ধার তরবারি অপেক্ষা অনেক কমেছে এখন, এ কী হত্যাকাণ্ড, আত্মহত্যা, নাকি রোগভোগে ছিঁড়ে গেছে নাড়ি?

খাঁচার গল্প শোনো তবে, ওই দেখো টিয়াপাখি পোরা খাঁচা, ওই দেখো সারি সারি কারখানা খাঁচা, ওই দেখো রাশি রাশি বক্তিমা খাঁচা, ওই দেখো টুনিদের, মণিদের, জনিদের খাঁচা—মন খাঁচা, ভাষা খাঁচা—তারা কোলাহল করে, সব খাঁচা একযোগে সবার বাঁধন শক্ত করে। ঘটনা, যে, এমনই এক খাঁচার বনে একদিন সাঁঝের বেলা আটকা পড়ে একটি লেখক অসাবধানে। রলাঁ বলে: আমার ভাষা শোনো, অদ্যকার দিনে লেখকের পাঁয়তারা আর চলিবেক না, ভাষা তার পৈতৃক না, ভাষা খাঁচার, খাঁচা ভাষার—চিহ্নগুণ প্রবল যেহেতু তার, জগতের যত ক্রিয়া, যত ক্লেদরাশি, তার ইশারায় হয়ে যাবে কাত (স্মর্তব্য যে, ‘সিংহাসন’ গড়ে গেছে কত রাজ্য, কত ইতিহাস )। ওহে পাঠক, ওই দেখো লেখা, নীল মলাটের ‘পরে লাল শালু ঢাকা, তুমি ওর ভাষাটুকু পড়ো, ভাষাটুকু ধরো, সভাকবির রমণীর নিতম্বের মাপ, কী দরকার তোমার বাপ তাতে, ছাপোষা কর্তাভজা বড়জোর অধ্যাপক, মহাশয় তুমি ওই লেখা, ওর মানে, ওর সহস্র সম্ভাবনা, সব তোমারই জন্য—বরং অবসরে খোঁজ রেখো, যুবরানি ঘুমোয় কেমনে, উপুড় না কি চিত হয়ে, পোশাক পরে না কি খুলে!


পূর্বকথা

শিল্প বিপ্লবের কালে এক আষাঢ় নিশীথে ‘ব্যক্তি’-টি জন্ম পেল ইওরোপে, যেহেতু চেতনার রঙে নীলও কালো হয়, কার্যকারণগত যুক্তিতে ঈশ্বর দ্রবীভূত হলো তার দেহে। যুক্তির বেড়াজালে বিজ্ঞানে দর্শনে রাষ্ট্রের ঘন ঘন আন্দোলনে, স্বাধীনতা হাতে পেল শেষে। আরও যে, ঐশী প্রভাবে সে অধীশ্বর হয় এমনকি প্রত্যন্ত প্রদেশে, অজভূমে। তখন বল নাচে সুন্দরীর সঙ্গে, ছবি আঁকে, গান গায়; টেক্সট লেখে কিংবা কবিতা, জ্ঞানপ্রসবিনী—তার মাথামোটা সন্তানের তরে—তো পাঠক, তুমি আর কতদিন ভেড়া রবে, লেখকের আশীর্বাণী মস্তকে নিয়ে পুণ্যতীর্থপথে আর কতকাল যাবে (রুল হাতে জিজ্ঞাসে রলাঁ)—ডাকিবে প্রভু, ঈশ্বর, নাথ?

বলো হরি হরিবোল, নগরীর গলিপথে কেন্নোর মতো, ক্রমে ক্ষুদ্রতর হয় মুখখানি, আহা, প্রজ্ঞাছাপ বলিরেখা মরুতে মিলায়, শবের মিছিলে দোলে মানুষ শত শত, তাহাদের জমাট হৃদয়—এমত যে, জগতের কী যে হবে কী না হবে—কে আর বলবে আগাম, হায়, সাহিত্য আঙিনায় কে আর গাইবে জয়গাথা পবিত্র ঈশ্বর কামনায়, ইত্যাদি স্মৃতি, ঘূর্ণির মতো ফেরে, ঝরে অশ্রুধারা। আততায়ী হেঁকে বলে—কেন শোক, বীতশোক হও, সব নিয়তির খেলা, তুমি আমি কেবলি নিমিত্ত; যে লোহার বাসরে ফুঁটো রাখতেই হত, নিচ্ছিদ্র নীরন্ধ্র দেখো যাহা, তারও মাঝে ফুঁটো থাকে, ফুঁটো-পথে ঢোকো তুমি, ক্রিয়া করো, প্রাণপণে মেটাও আকুতি—তখন মাখন হয়, মন্থনের ঝোঁক হেতু ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হয়, লেখা পায় অ-পূর্ব প্রতীতি।

ওই দেখো নীলাকাশ, কেমন নির্মল রজঃক্ষান্ত নারী যথা—ঝরিয়ে দিয়েছে সব জ্ঞান সাগরে পাহাড়ে, নগরীর কলরোলে-তুমি লিপিকার—তুলে নাও এটি ওটি, রুচি সম্মত যাহা: ও ভুঁইচাঁপা, কলিমুদ্দি, পেপসির হ্যাপা—সাজাও যতনে (ফুঁটো রেখো চেতনে বা নিশ্চেতন); প্রকাণ্ড অভিধানে শব্দ আছে, তাদের বিভক্তি, চিহ্ন আছে, তাদের সংযুক্তি, বেছে নাও—তো ইত্যাকার প্রকৌশলে সৃষ্টিকর্ম নাই, ভগবত প্রদত্ত মহিমা কার মুদ্রাদোষে যেন মিশেছে নিবৃত্তির সারাৎসারে; মূল যার ছিঁড়েছে বিষম ঝড়ে, সে-ই মানুষ, কেন্দ্রাতিগ বলে ছুটছে বাইরে—মৌলিক কেমনে হবে—মূলধন নাই, মৌল কর্ম নাই; আছে শুধু অজস্র বিন্যাসে, এখানে ওখানে যত জ্ঞান মাটির উপরে, তাই দিয়ে শেষহীনভাবে কোলাজ গড়ে তোলা আপন আপন ক্যানভাসে, চিহ্নের তন্তুসমবায়ে বালুচরী, জামদানি, কাঞ্জিভরমে: লেখা এক অনুলিপি—ইহা হারাইয়া গিয়াছে, সংস্থাপিত হইয়াছে অসীমে।

একদিন পোলভল্ট দিতে গিয়ে অভিকর্ষের দড়ি ছিঁড়ে গেলে, পাঠক অধিষ্ঠিত হয় শূন্যগর্ভে, নিরালম্ব, নৈর্ব্যক্তিক—সেথা সময়ের শঙ্কু দোলে প্রসর বিশ্বে, গ্রহ তারা ছুটে চলে বক্রতল বেয়ে, কর্কট বৃশ্চিক চরে ধূসর পদার্থে, অলটার ইগো, হুগো দ্য ভ্রিস‌্, পিপীলিকা সারি চলে হেঁয়ালি মুনিষ, ছেড়াখোঁড়া টপ কোয়ার্ক, পালসার বাইনারি, ব্যবহৃত ন্যাপকিন কিংবা অ্যাজিডোথাইমিডিন, প্রোলেটারিয়েনাইজেশন, ম্যারিকান অ্যাগ্রেশন, লাল-লাল-লারা তেন-তেন-ডুলকার, পটলাশ ইতুপূজা ঘেটুল বা লিভ-টুগেদার—ইত্যাদির মাঝে আছে সুপার স্ট্রাকচার-বেস, অ্যাপিয়ারেন্স-এসেন্স। ইহাদের আর্ন্তবুননে লেখা উৎপন্ন হয়, বহু সংস্কৃতি বিচিত্র সংলাপ উৎকট বিতর্কের মহাসম্মিলনে যদিচ এবংবিধ বহুমাত্রাজ্ঞানে, প্রথম পুরুষ, সে, পাঠক অবগত নহে (ইতিহাসজীবনী-মনস্তত্ত্ব, শুধু পুরুষোত্তমের অধিগত); সে রতি ক্রিয়াকে বলে কেরোসিন, কেরোসিনকে করে চন্দ্রমল্লিকা—(দোল খা-রে পাঠক, দোল খা) সে রহস্যের জরায়ুতে ঢুকে লেখার সত্ত্বাকে বুদবুদ করে, মুক্ত করে চরম অর্থকে আপেক্ষিকের সুশৃঙ্খলে।

অগণন অমৌলিক লেখার সঙ্গমে, একটি জারজ লেখা পড়ে আছে, ডাস্টবিনে, পাঠকের অধীনে—আজ থেকে পাঠ হলো শুরু।

আমার দেরিদাদা (অনেক কবচ-মাদুলি, সতীমার থান, মানসিক, দেরিতে জন্ম বলে নাম তার দেরি), দৈত্যাকার ঠ্যাং তার, কাষ্ঠহাসে, বলে: বুজরুকি অনেক হয়েছে, থাম্। ঈশ্বর, অধিবিদ্যা ভড়ংবাজি যত, সব ছিঁড়ে কেটে টেনে বাইরে আন। জ্ঞানী-গুণী-মুনিজন-কৃত রচনাসামগ্রী—সে সকল জন্মলগ্নে ভগ্নভাষা তাদের অধিবিদ্যার রহস্যে জারিত, মেটাফর সব—শব্দগুলি, ভাষার কাঠামো ডিফারেন্সে-ডেফারেন্সে অর্থ বদলায়, তদ্ভব হয়—তারা লিখে গেল ‘ভালোবাসো’, এরা পড়ে ‘ঘৃণা’—ভাষার যাদু-ই অমন, শুধু কানামাছি খেলা, এই বুঝি ধরে ফেলি, তার অনন্ত অর্থ সম্ভাবনা। আয়, বরং ঢুকে পড়ি মার্জিনে, সেথা যত সুপ্তচিহ্ন ফসিলের রূপ ধরে রয়, রঙ্গে ব্যঙ্গে তাদের কাছা ধরি টেনে, তুলো ধুনি, শোধন করি পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেটে হাড় তন্তু পেশী মজ্জা ঝুলিয়ে রাখি ফরম্যালডিহাইডে—তখন অবিনির্মাণ হয়—এক কালোত্তীর্ণ অর্থপ্রাপ্তির তাগিদে—ব্যতিক্রমী দ্যোতিতে।

বলো হরি হরিবোল, শ্মশানের চিতাকাঠে লেখকের শব ওঠে, লোমকূপ পথে ঝরে, আবেগ-অনুভূতি-রসবোধ, ক্রমে তারা প্রজাপতি হয়, শঙ্খচূড় হয়, পানকৌড়ি হয়। এমতাবস্থায় দিগ্বিদিকে অনুনাদ তুলে আওয়াজ হলো: ঠং—পাথরে খোদিত হয় লিপি, হাতুড়ি-ছেনির কোপে, ছিন্নশির লিপিকার, হাতে তার বিদ্যুতের গতি—স্বয়ংক্রিয় লেখা হয়: ‘মর্ডান টাইম‌্স পোস্ট-মর্ডান টাইমে। আরো আসে লিপিকার, জুলফিকার, খগেনের ব্যাটা-মস্তক বন্ধক রেখে—লেখা হবে বলে, আজ লেখা ভাঙার লেখা, আজ শুধু ডিসকোর্স (ইহা ইন্টারকোর্স আর ডিভোর্সের মাঝামাঝি অবস্থিত), বহুধ্বনিময় বক্তব্য-মতামত বিভিন্ন চিহ্নজ্ঞাপনকারী দ্যোতক ব্যবস্থায় উৎকীর্ণ হয় পাথরে, দেওয়ালে, বিছানায়-খাটে, প্রস্রাবখানায়, প্রসূতি সদনে—তাহাদের কোনো উৎস নাই, কণ্ঠস্বর হারায় অসীমে। লেখা সেই নিরপেক্ষ, মিশ্র, তির্যক স্থান—সেই ঋণাত্মক জগৎ—যেখানে হরিণের কামে মজে সরলা ময়ূরী, ঝিঁঝি ডাকে হাম্বা রবে, পেচকের হিহি-ঢিঢি, জ্যোৎস্না-রা দাড়িয়াবান্ধে জোনাকির সঙ্গে, শ্যাওড়ার কালো ঝোপে ‘বউ কথা কও’ বলতে গিয়ে ‘মাগীর চটক কত’ বলে ফেলে ‘চোখ গেল’ পাখি।

পাঠের অযুত অর্থ-সম্ভাবনায় পাঠ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লিপি পড়ে থাকে, আনডিসাইফার‌্ড।


শবোত্থান

চিতাকাঠ নিভে যায় একে একে, শ্মশানের যাত্রী সব ফিরে গেছে নিজ নিজ বাড়ি চিনে, শুধু কিছু চিতাভস্ম ইতস্তত উড়ে ফেরে বৈশাখের মৃদু সমীরণে, ওই দূরে দিশেহারা নেশাখোর বিড়বিড় করে—দূর্বার সবুজে শুয়ে আধোজাগরণে, আজ রাতে, চন্দ্রালোকে মাখামাখি হিজলে শিমুলে, পৃথিবীকে মহামারি মড়কের ভাগশেষ মনে হয়—গুটিকয় প্রেতচ্ছায়া সাম্বা নাচে এ গাছে ও গাছে, কঙ্কাল হৃদয়ে বাজে ভানুমতী কান্নার মতো চৌরাসিয়া বাঁশি, আর ক’জনা আউলে-বাউলে নিজেদের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে করে খুনসুটি।

মিসেস্ কথাকমি চ্যাটার্লি-র ফ্রিজ-ব্রা-অ্যান্টেনা-ডিশে এখন ইউপ্পা-হিউপ্পা-জিং কাওয়া-চিকা-ডিং, এপাড়ার চতুর্থতল ফ্ল্যাটে, অভাগিনী—হায়—কত শত বৎসর ধরে কাপ-ডিশ ধুতেছিল, ভোঁদড়ের কত লাথি কোল পেতে সয়েছিল; তো তাহার গ্রহরাজ তাবিজটি বড্ড সেকেলে মডেলের, ‘গেট-আপ’টা বদলাতে কতবার বলা হলো ভোঁদড়কে, হালের ডিজাইনে, কথা শোনে না। ওদিকে লেট-নাইট ন্যুড সিনে—’মুখপোড়া মাগীমিনসের মরণ নাই গা’, এইরূপ প্রশংসায় উদ্ভাসিল মালিপাড়ার মেজো খেদির মা, তাহার শুচিতার বাতিক বানে ভাসিয়া গিয়াছে। আকাশপথে উড়ে নামছে একঝাঁক বহুজাতিক, বি প্র্যাগমেটিক বি প্র্যাগমেটিক, পৃথিবীর এই কোণে নীল কোট ওই কোণে সাদা জামা, চলিবে না, তোমরা এমনকি মাংস রাঁধতেও জানো না, ম্যাডোনার ডোনা ডোনা বুক ছাড়া মেটিরিয়াল পৃথিবীতে কীইবা আছে ছাই, শোয়্যারজেনেগার কে বা কেন শ্যারন স্টোন, কেননা বাজার চাইছে, তাই। ভাগাড়ের ঊর্ধ্বাকাশে শকুন উড়িবেই, সে তুমি যতই ক্যানেস্তারা পেটাও: বরং হাল ছেড়ে এসো বন্ধু, ফ্যাশনের—প্যাশনের—মিস্ দে দে কিস মিস্ ইউনিভার্স (বুক-কোমর-পাছা মাত্র নয়, ইহাদের মানসিক সৌন্দর্যও প্রভূত পরিমাণে বিদ্যমান), বিজ্ঞাপনের ড্রিংকস কিংবা সাবান, কচি কচি লাল লাল, মাশরুম গাল, থুড়ি, মডেল—চিয়ার্স—লেট‌্স সে চিয়ার্স, ইউ ব্লাডি ফুল মাই ফ্রেন্ড।

বাস্তবের উলটো পিঠে আর এক বাস্তব থাকে বুঝি? আজ এই আলো-আলো নিবুনিবু নবমীর ভাঙা চাদে, সেই যেথা এককালে বুবুনের খেলাঘর ছিল, আমডাল ঝুলে এসে ধরা দিয়েছিল তার কচি দুটি হাতে; সেথা গাছ কেটে ধানক্ষেত, ধান কেটে তেলকল, তেলকল ভেঙে জুটমিল, হতে হতে ভূমিকম্পে, রোদে-জলে ঘষে-মেজে-ক্ষয়ে পোড়ো রুক্ষভূমি, কঙ্কালের মতো, আকাশের তারা দেখে ফোকলা দাঁতে হাসে। ভগ্নস্তূপ ইট কাঠ, বেড়ালের ছানা, গুটিকত গুটিপোকা উচ্চিংড়ে ডেঁও পিপড়ের বাস, ইঁদুরের বাঁদরের পরম্পরাগত খেয়ালিপনায় জ্যোৎস্নাও ঘোলা আজ, চাঁদের এপাশে ওপাশে কুচো মেঘ রাজহাঁস।

ভগ্নস্তূপে বসিয়া তিনখানি মানুষের ছায়া নেশা খাইতেছিল; অনুচ্চ কণ্ঠে তাহাদের কথোপকথন চলিতেছিল; দূরে—নদী তীরে—কুঁড়ে ঘর থেকে আবহসংগীতে বাঁশি বাজিতেছিল।


কথোপকথন

দেখেছো তুমি, কাল সারারাত জেগে চোখে রক্ত উঠে গেছে: একের পর এক ঊর্ণা কেটে কেটে—মাঝরাতে ধলাগাই-এর কালো বকনা-টা প্ল্যাসেন্টা ফেটে যেমন বেরিয়ে এসেছিল আর কী—নিঃসীম আঁধার গুহাপথে, শিঞ্জিত শাঁখা সিঁথি কফ-থুতু-কাথ-বীর্যে ঘন আর গাঢ় হয়ে, বিম্বাধর অখিবাঁকে স্তনাগ্র হাতছানি গ্যাসবেলুন হাসির দমকে হেঁচকা টানে ছিটকে এসেছি; তখনি শুকনো খড় রঙের রোগা ভাঙা ডালে একটা গিরগিটি, মাথা নেড়ে, জগতের আশার তলানিটুকু নস্যাৎ করেছিল, আঞ্জনি-র বীভৎস রং-রস লেগে চোখে মুখে ঠোঁটে ছাপ হয়ে—ঘৃণার, ঘৃণিত হবার কারণ দর্শিয়ে গেল: বেহায়ার মতো এসেছি তবু, দেখছো তুমি?

তোমার বড় তেষ্টা পেয়েছে? কবি? হাঁপাচ্ছো কেন? খাবে কিছু পুঁটিরামে, ভাল্লাগে না ? তবে কী হলদিরামে, এই নাও রুমালটায় মুখ মোছো, চলো তবে ট্রামেই চাপি, আর ফিরো না গণ্ডগ্রামে, এইখানে এই কলতলাতে কেমন হাওয়া বইছে দেখো মুখটা ধুয়ে; উঁহু-উঁহু, ওটা নোংরা, ওদিকে তাকায় না সোনা, ওহো, কানের আঙল দুটো সরিয়ে নিয়েছ? শুয়ে শুয়েই লিখবে তুমি—তা লেখো—আমি বরং তোমায় একটু হাওয়া করি, আরাম পাবে, আলোছায়ার ঝোপের তলে আঙুলগুলো তোমার চুলে—ঘুম পাচ্ছে? যদি ঘুমোবেই, তবে আমার কী হবে? কবি? আমায় নেবে তোমার সঙ্গে, ঘুমোতে?

আবহমানকাল যাবৎ, মানুষের চালিয়াতি মানুষের অস্তিত্ব এবং তাহার চালিকাশক্তিকে সংজ্ঞায়িত করিয়া আসিতেছে। আসিতেছে না কি?

তোমার মোটা মাথায় যাকে চালিয়াতি বলো, তা কালোয়তি।

আমি দু-খানা পাখা চেয়ে নিয়েছি, জানো, সারসের থেকে, কাল রাতে মহড়া দিয়েছিলাম ছাতে—ওরা আমার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল, যে, আমি নাকি পোয়াতি হাঁসের চেয়ে বেশি স্মার্ট হাটতে পারবো না কখনও—তো আমি উড়েই দেখাব; আর কতদিন ধরে বলো খোকা-খুকু খুক খুক গদ্য কেশে যাব, অতৃপ্ত রতিক্লান্তির মতো এলেবেলে ঘ্যান ঘ্যান ন্যারেটিভ ঝেড়ে যাব–ছাতে উঠে, পাখা দুটো বেঁধে নিয়ে পিঠে, দু-একখানা লাফ মেরে দেখলাম—হাওয়া ধরছে, আশার কথা, কি বলল, হাওয়া সরছে।

পরম করুণাঘন ঈশ্বর, দৈবপাকে, নিদ্রামগ্ন না হইলে, দুই চারিখানি অতিরিক্ত ফুসফুস কি বরাদ্দ করিতেন না? উড়িবার তরে?

নিন্দুকের কথায় কান দিও না কবি, ওদের স্বভাব চাটা, সুযোগ দিলে চাটবে ওরা সবই, এই তো দেখে না ব্যানার্জিদের বুবি কেমন সাধাসিধে ছিল বলো, হাল কী করেছে দেখেছ—কী না, বুবি উত্তরে হাওয়ার তোড়ে ঢুকে পড়েছিল পাঠ্যের গণ্ডিতে, একটু ওম নেবে বলে, ফায়ারপ্লেসের আগুনটা উসকে নিয়ে বসেছিল ইতিহাসে, দর্শনে, অর্থনীতি আর সৌন্দর্যতত্ত্বে; এবং তখন ফোকাসে মস্তিষ্ক রেখে উপবৃত্তাকারপথে কত কত পাঠ্য উড়ে চলেছিল ওই অতদূরের নীহারিকাপুঞ্জ অবধি, অভ্রচুর্ণ ঝরেছিল পৃথিবীর রক্তশূন্য রাজপথে, পথের উপরে। বেড়ে ঝাড় খেয়েছে বুবি, ওদের কুমন্ত্রণা শুনে, যোগের লালসায় হেজে গিয়ে, এখন কৃমিকীটের তদারকি করে শুধু।

আমিই তাহা হইলে ভিলেন হইলাম? তথাস্তু।

না, তুমি স্মৃতিভ্রষ্ট, তোমাকে বিস্মৃতির অতল অন্ধকার থেকে তুলে নিয়ে যাব আমি। জানো, কাল রাতে—ওই যে অন্ধকার দেখছ দিনের আলোয়, ওখানে জোনাকির নিওনে, কতগুলি রাতজাগা পাখি উড়ে এসেছিল, চন্দ্রগুপ্ত পুলকেশী থেকে শুরু করে একালের হেঁচকি তোলা এলোকেশী, তাদের বোধিসত্ত্ব নির্যাস, হৃদয়ের একটুকু মরা ডাল খুঁজেছিল, রিমঝিম নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে একখানি মৃত সুর—প্রলম্বিত, বিলম্বিত বিশ্রম্ভালাপে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল নিধুবাবুর; আর জানোই তো নিধুবাবু কেমন রগচটা রাশভারী, আর যেই না ছাদে ওঠা, এক বে-আক্কেলে চামচিকে তাঁর চকচকে টাকটাতে চুমু এঁকে গেল—আশ্লেষে মরে যায় আর কী, নিধুবাবু, কতকালের টপ্পাটার ধুলো-কালি মুছে জোরে মারে টান, কল্কে ফাটে না ফাটে, বাপরে—তখন সবে ঝড়ঝড় করে গেল দিনের প্রথম ট্রাম, কাকের থেকে ধীরে ধীরে কম কালো হয়ে এল ইলেকট্রিকের তার, কর্পোরেশনের দাঁত কেলানো ময়লা ফেলানো ভ্যাটের উপর আপনমনে প্রাতঃকৃত্যে কয়েকটা শালিখ, চায়ের দোকান আঁচের ধোঁয়া কেবল টিভি চিল চিৎকার—আর তখনি ভোরের আলোয়…




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com