মানুষ যখন সমাজবদ্ধ হতে শুরু করে তখনও উদরপূর্তির জন্য তার বনের পশুপাখি শিকার অথবা গাছের ফলফুল সংগ্রহের নেশা পুরোপুরি কাটেনি, তবে জীবনধারণের উপায় হিসেবে মুখ্য ভূমিকা নিতে শুরু করেছে চাষবাস। চাষের জন্যে যা-কিছু করণীয়—যেমন মাটি কোপানো, মাটিতে জলসেচন তারপর বীজবপন—তাকে করতে হয়েছে। আর তার ফলশ্রুতিতে মাঠ ভরে উঠেছে ফসলে।
তখনকার কালের মানুষের আজকের মানুষের মতো এমন বিজ্ঞান-সচেতন হওয়া সম্ভব নয়। তারা জানত না সূর্যের আলোর সঙ্গে গাছের কী সম্পর্ক, বৃষ্টির সঙ্গে মাটির কী যোগ—কী রহস্য লুকিয়ে আছে চাষের জমিতে উপ্ত বীজের ফসল হয়ে ওঠার মধ্যে। তারা ভেবে নিত, এসব কিছুর পেছনেই আছে যাদুবিদ্যার কারসাজি! যাদুর মায়ায় মোহিত হয়ে, তারা মাঠে চাষ শুরু করার আগে, চাষের জন্যে করণীয় কাজগুলির পুনরাবর্তন ঘটাত। একই ভাবে তারা শিকারে যাবার আগেও শিকারের জন্যে করণীয় কাজগুলি একবার ঝালিয়ে নিত। অন্তর্নিহিত কার্য-কারণ সম্পর্ক না জেনে, তারা মনে করত এসবই যাদুবিদ্যার কারসাজি! লোকসংস্কৃতির ভাষায় এরই নাম—’সদৃশ যাদুবিধান’। তখনকার মানুষের মনে বদ্ধমূল এই ধারণা ছিল যে, জীবনের সর্বক্ষেত্রে কাজে নামার আগে এইসব অনুকরণমূলক অভিনয় সমাধা করতে পারলে, কার্যক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভ অনিবার্য। আর অভিনয়ে যদি কোনো খুঁত থেকে যায়, যাদুশক্তি কাজ করবে না—কার্যসিদ্ধিও সম্ভব হবে না। রোগ নিরাময় করার আগে একজন লোক-চিকিৎসকের কেমন ভূমিকা পালনীয়—তা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ আবদুল হাফিজ তাঁর ‘বাংলার লোকিক ঐতিহ্য’ গ্রন্থে মাষাণ নামে এক অপদেবতার কোপদৃষ্টি থেকে রেহাই পাবার জন্যে একটি বিশেষ আঞ্চলিক প্রথার উল্লেখ করেছিলেন। সে-সূত্র ধরেই পশ্চিমবঙ্গের এক লোকসংস্কৃতিবিদ, মানস মজুমদার তাঁর প্রবন্ধে বলেছেন :
নীলফামারি জেলার সর্বত্র দেখা যায় কোনো বাড়িতে একই সময়ে কোনো লোক রোগাক্রান্ত হলে বা পরপর দুই-তিন ব্যক্তি মারা গেলে, ওই ঘটনাকে মাষণ দেবতার কোপদৃষ্টি বলে গ্রামের লোকে বিশ্বাস করে। এ-অবস্থায় সাধারণ চিকিৎসায় কোনো ফল হয় না বলে তাদের ধারণা। এই কোপদৃষ্টি হতে নিষ্কৃতি পাবার জন্যে গ্রামোর লোকেরা এক শ্রেণীর ফকির বা গুণিকের শরণাপন্ন হয়। ফকিরেরা মোটা টাকার বিনিময়ে মাষাণ দেবতার তুষ্টি বিধানের ব্যবস্থা করেন।
ব্যবস্থাটি কেমন? শনি বা মঙ্গলবার দুপুর রাত্রে রোগাক্রান্ত গৃহস্থের বাড়ির উঠানে রাখা হয় মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়ার খাট। তাতে ফকির বা গুণিক মৃতের ভান করে শুয়ে থাকে। এর আগে অবশ্য বাড়ির চার কোণে মন্ত্রপূত তাবিজ আর মাটির বাসনে শোল মাছ রেখে, মাছ সমেত বাসন মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। এরপর তিনজন ফকির মৃতের ভানকারীকে নিয়ে, লোকজন-সহ চলে যায় শ্মশানে বা কবরখানায়। কবরের পাশে বা যেখানে দাহ করা হবে সেখানে, পাশে রেখে দেওয়া হয় কাটা কলাগাছের একটা খণ্ড। মৃতের ভানকারী সেই কলাগাছের খণ্ডটি কবরে বা দাহস্থানে ফেলে দিয়ে, সেখান থেকে পালিয়ে যায়। স্পষ্টতই এটি একটি সদৃশ যাদুবিধানের দৃষ্টান্ত।
অনুকরণমূলক লোকচিকিৎসার প্রসঙ্গ ছেড়ে, এবার বরং চাষবাসের প্রসঙ্গে আসা যাক। আগেই বলেছি, সূর্যের আলো, আকাশের বৃষ্টি, মাটি কোপানো, বীজবপন ইত্যাদির মধ্যে যে গভীর সম্পর্ক—তা না বুঝেই সেদিনের মানুষ চাষের কাজে অনুকরণমূলক অভিনয় করে যেত। যার ফলশ্রুতিতে মাঠ হয়ে উঠত উর্বরা। মাটির বুকে গজিয়ে উঠত কচি শস্য। এর সঙ্গে সেদিনের মানুষ তার সংসারজীবনে নারীর গর্ভধারণের সাদৃশ্যও খুঁজে পেয়েছিল। সেখানেও মনে করত সে, তার পেছনেও নিশ্চয় যাদুবিদ্যার কারসাজি আছে। কৃষিকৃত্যে সদৃশমূলক যাদুবিধানের নানান দৃষ্টান্ত কাহিনিরূপ লাভ করেছে পুরাণকথায়—কোথাও হরগৌরীকথায়, কোথাও সীতারামকথায়—কোথাও বা অন্য কোনো রূপে। সীতারামের পুরাণকথা তো আসলে কৃষি সভ্যতার অগ্রগতিরই কথা। সাতকাণ্ড রামায়ণ সাতকাহন করে বলে, এখানে কেবল হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য-অনুবাদিত বাল্মীকি-রামায়ণের প্রবোধচন্দ্র সেন-কৃত ভূমিকার প্রাসঙ্গিক অংশ স্মরণ করা যেতে পারে :
কৃষিবিস্তার উপলক্ষে আর্য-অনার্য সংঘাতের কথাই হল রামায়ণের অন্যতম মূলকথা। এটাই হল রামায়ণের রূপকার্যের আসল তাৎপর্য। সীতা, রাম ও লক্ষ্মণ হলেন এই কৃষিসভ্যতার প্রতীক। বিশ্বামিত্র আর জনক হলেন তাঁদের প্রবর্তক ও সহায়। বিশ্বামিত্রের প্রবর্তনার ফলেই যে রাম-সীতার মিলন, অহল্যা-উদ্ধার ও রাক্ষস-সংঘাতের সূত্রপাত—এ-কথা রামায়ণ কাহিনী থেকে স্পষ্টভাবেই জানা যায়। আর কৃষিবিস্তার ও রাক্ষস-শক্তির বিরোধ যে জনক রাজার জীবনের ব্রত ছিল—এ-কথাও রামায়ণে প্রচ্ছন্ন নয়। প্রাচীন মহাপুরুষদের মধ্যে জনক যে আর্যসভ্যতার একজন ধুরন্ধর ছিলেন, নানা জনপ্রবাদ সে-কথা সমর্থন করে। ভারতবর্ষে কৃষিবিস্তারে তিনি একজন উদ্যোগী পুরুষ ছিলেন। তিনি স্বহস্তে হল চালনা করতেন। তাঁর কন্যার নামও সীতা অর্থাৎ হলরেখা।
সেদিনের বিজ্ঞানচেতনাহীন মানুষের কৃষিকৃত্য নিয়ে সদৃশ যাদুবিধানের চিত্ররূপ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধরা আছে নানা দেশের পুরাণকথায়। সেইসব পুরাণকথায় প্রবেশ করার আগে সাধারণভাবে পুরাণ কথা নিয়ে কিছুটা আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে।
ইংরেজি ভাষায় যাকে মিথ বলা হয়, তাকেই কাজ চালাবার কারণে আমরা বাংলা ভাষায় বলি পুরাণকথা। মিথ-এর এক চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ কে. কে. কেলেট। তাঁর ব্যাখ্যা-অনুসারে, খ্রিস্টের জন্মের হাজার-হাজার বছর আগেকার বাপ-মায়েরাও এখনকার বিজ্ঞানমনস্ক বাপ-মায়ের মতোই গল্পের ছলে তাদের ছেলেমেয়েদের কোলে নিয়ে শোনাত; জগতের সৃষ্টি-রহস্যের কথা; বলতো চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা-আকাশ-সাগর-পাহাড় ইত্যাদি সৃষ্টি হলো কেমন করে। কেনই বা রামধনুতে সাত রং এল; কেনই বা চিতাবাঘের গায়ে কালো চাকা-চাকা দাগ; কেনই বা ময়ূরের পালকে অমন রঙের বাহার। বলা বাহুল্য, তাঁদের সে সব কথায় কল্পনার রং লেগে থাকত বিস্তর। কিন্তু সে-কথাগুলিই ছিল তাঁদের কাছে সত্য।
কেলেট সাহেব সাধারণভাবে যাকে মিথ আখ্যা দিয়েছেন, মার্কিন লোককথাবিদ স্টি্থ টমসন তাঁকেই এক্সপ্লানেটারি টেল বা ব্যাখ্যাদানকারী কাহিনি বলেছেন, এবং তাকে মিথ-এরই একটি শাখা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। স্টি্থ টমসনের মতে মিথ হলো এমন কাহিনি—যার মধ্যে বর্তমান বিশ্ব নয়, একটি অতীতের বিশ্ব বর্তমান। তাঁর মতে এসব কাহিনিতে দেবতা, আধা-ঐশ্বরিক নায়ক বা বীর এবং সমস্ত রকম বস্তুর সৃষ্টি-রহস্য বর্ণনা করা হয়। মিথ মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এগুলি কখনও বীরকাহিনি কিংবা ব্যাখ্যাদানকারী কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। তবে সে সব কাহিনিকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে, তাকে ধর্মীয় তাৎপর্যমণ্ডিত করা হয়। মিথ-এর নায়ক কোনো-না-কোনোভাবে মূল কাহিনির সঙ্গে বাঁধা থাকে। মূল কাহিনিতে দেবতা বা আধা-ঐশ্বরিক নায়কদের অসংখ্য অভিযাত্রার বর্ণনা থাকে। মিথ বা পুরাণকথাকে বাংলাদেশের বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ ড. আশরাফ সিদ্দিকী মোটা দাগে দুটি ভাগে ভাগ করেছেন—ধর্মপুরাণ কথা এবং লোকপুরাণ কথা। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য সিদ্দিকী সাহেব-কথিত ধর্মপুরাণকে মিথ-এর সঙ্গে অভিন্ন জ্ঞান করে সমগ্র মিথকেই লোকসাহিত্যের আওতা থেকে বাইরে রাখতে চান। যেহেতু ধর্মপুরাণকথায় অবিমিশ্রভাবে দেবদেবীর মাহাত্ম্য কীর্তন করা হয়। টমসন সাহেব অবশ্য মিথকে অতটা অচ্ছুৎ মনে করেন নি। তাঁর মতে মিথ-এর মধ্যে ধর্মের ছোঁয়া আছে বটে, কিন্তু তা ধর্মপুরাণের মতো অবিচ্ছেদ্যবন্ধনে আবদ্ধ নয়। মিথ-এর মধ্যে তিনি লোককথায় প্রচলিত বহু টাইপ ও মোটিফের সন্ধান পেয়ে সানন্দে তাকে লোকসাহিত্যের অঙ্গীভূত করেছেন।
তত্ত্বকথার ভণিতা ছেড়ে কিরাত উপজাতির অন্যতম শাখা খাসিয়াদের পুরাণকথার ভাণ্ডার থেকে কৃষির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কযুক্ত এক কাহিনি পাঠ করলে দেখে যায়—তার মধ্যে সদৃশ যাদুবিধানের নিদর্শন যেমন আছে, তেমনি ব্যাখ্যাদানকারী কাহিনির গুণ আছে, আছে ছোট প্রাণীর বুদ্ধির কাছে বড় প্রাণীর হার স্বীকার করা ইত্যাদি ‘লোককথার গুণ’ এবং সর্বোপরি আছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ চমৎকার কাহিনি।
কাহিনি-পাঠের পূর্বে, কাহিনিকে বুঝতে কিরাত উপজাতির শাখাবিশেষ খাসিয়াদের বিষয়ে দু-চারটি কথা জেনে নেওয়া জরুরি। খাসিয়াদের চেহারা মোঙ্গলীয় ধাঁচের, এদের রক্তে কিরাত রক্ত বহমান। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এরা, এদের প্রতিবেশী গারো প্রভৃতি অন্যান্য মোঙ্গলীয় জাতির লোকেদের ভাষার সম-শ্রেণির নয়। বরং বহুদূরবর্তী বিহার ও ছোটনাগপুরের সাঁওতাল-মুণ্ডা-হো প্রভৃতির ভাষার সঙ্গে এদের আশ্চর্য মিল আছে। পণ্ডিতরা এ-বিষয়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, রক্তে মোঙ্গলীয় খাসিয়ারা অতীতে যে-কোনো কারণেই হোক নিজেদের ভাষা পরিত্যাগ করে, সাঁওতাল-মুণ্ডা-হো প্রভৃতির ভাষা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
নলিনীকুমার ভদ্র জানিয়েছেন, খাসিয়া ভাষার একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এই ভাষার সমস্ত বিশেষ্য পদ হয় পুংলিঙ্গ, নয় স্ত্রীলিঙ্গ। শব্দের আগে উ প্রত্যয় পুংলিঙ্গের দ্যোতক, আর কা প্রত্যয় স্ত্রীলিঙ্গ নির্দেশ করে। এদের লিঙ্গ-প্রকরণ ভারী অদ্ভুত। যেমন সূর্য (কা-স্নি, সূর্যের অধিষ্টাত্রী দেবী) স্ত্রীলিঙ্গ, আর চন্দ্র (উ-রাই) পুংলিঙ্গ। হাতি মাত্রেই, সে মদ্দাই হোক বা মাদীই হোক, স্ত্রীলিঙ্গ—কা-হাতি। তেমনি স্ত্রী-পুরুষ উভয় প্রকারের ময়ূরই উ-ক্লিউ। মাতৃক প্রথা খাসিয়া সমাজব্যবস্থার একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। তাদের পরিবারে মা-ই প্রধান বলে গণ্য হন। গোষ্ঠীর সৃষ্টি তাঁকেই কেন্দ্র করে হয়। খাসিয়াদের একটি প্রবচন আছে: ‘লং জাইড না কা কন্থেই’। অর্থাৎ, স্ত্রীলোক থেকেই কুলের উদ্ভব হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে খাসিয়া এবং গারো এই দুটি জাতি ছাড়া আর কোনো জাতির মধ্যে মাতৃক প্রথার চল নেই। খাসিয়াদের সমাজে সকল বিষয়েই মেয়েদের কর্তৃত্ব দেখতে পাওয়া যায়। পূজা-পার্বণাদি প্রধানত নারী-পুরোহিতদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়।
কিরাতী কাহিনি:
সে অনেকদিন আগেকার কথা। তখন পশুপাখি মানুষের সঙ্গে কথা বলত। মানুষও তাদের কথা বুঝতে পারত। আজ কিন্তু তারা সেই ভাষা ভুলে গেছে। পালটে গেছে তাদের অনেকের রূপও। যেমন ধরা যাক উ-ক্লিউ অর্থাৎ ময়ূরের কথা। সেই আদি যুগে উ-ক্লিউ ছিল ধূসর পাখাওয়ালা কুৎসিত এক পাখি। তার পাখায় এত রঙের বাহার তখন ছিল না। তবু কিন্তু তার দেমাকে ভুবন অন্ধকার।
তার ঝুটিটা ছিল অন্য পাখিদের চেয়ে অনেকটা খাড়া আর লেজটা বেশ লম্বা। এই খাড়া ঝুটি আর লম্বা লেজের দৌলতে মাটিতে তার পা পড়ে না। তার চারপাশে যেসব ছোট আকারের পাখি, তাদের সে করুণার চোখে দেখে। তাদের সঙ্গে সে মেলামেশা করে না। তার গতিবিধি বড়-বড় আড্ডায়। বড় বড় পাখিরা যখন বনে বিরাট ভোজের আয়োজন করত তখন সেখানে তার নিমন্ত্রণ হত। এর ফলে উ-ক্লিউ নিজেকে একজন হোমরাচোমরা মনে করতে লাগল।
তার উন্নাসিকতায় ছোট ছোট পাখিরা তার ওপর বেজায় খাপ্পা। তারা সবাই মিলে ফন্দি আঁটতে লাগল কীভাবে এই হামবড়া উ-ক্লিউকে জব্দ করা যায়। তারা জানত উ-ক্লিউ তোষামোদ পছন্দ করে, আর তোষামুদে কথা শুনলে তার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়।
একদিন তারা নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে সবাই মিলে গেল উ-ক্লিউর কাছে। হাত জোড় করে তারা বলল, নীলিমার দেশে কা-স্নির কাছে পাখিদের বার্তা পৌঁছে দেবার জন্যে আমরা তোমাকেই আমাদের যোগ্য প্রতিনিধি মনে করি। কা-স্নি, যিনি পৃথিবীতে সোনার আলো ছড়িয়ে দেন, তার সামনে তুমি ছাড়া আর কে দাঁড়াতে পারে বলো?
পাখিদের প্রস্তাব শুনে উ-ক্লিউ তো আনন্দে আটখানা। সে ভারিক্কি চালে জানাল, ওহে, আমারও তো অনেকদিন থেকে সেখানে যাবার ইচ্ছে, আমার দ্বারা তোমাদের যদি কোনো উপকার হয়, তবে তা করতে আমি কসুর করব না। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও জেনে রাখো, নীলিমার দেশে গিয়ে আমি আর ফিরে আসব না—কা-স্নিকে বিয়ে করে সেখানেই থেকে যাব।
উ-ক্লিউর কথা শুনে ছোট পাখিরা এ-ওর দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল। তারা ভাবল, আহাম্মকটা বলে কী, অত বড় বপু নিয়ে যে কিনা গাছের মগডালেই উঠতে পারে না, সে যাবে নীলিমার দেশে উড়ে?
কিন্তু তাদের সবাইকে অবাক করে, উ-ক্লিউ সত্যিই উড়ে গেল আকাশের পথে, নীলিমার দেশে।
নীলিমার দেশে পৌঁছে, উ-ক্লিউ ঘুরতে ঘুরতে এক বিশাল প্রাসাদের সামনে এসে থামল। সেই প্রাসাদে একলা থাকতেন কা-স্নি। কা-স্নি যেমন অসাধারণ রূপবতী তেমনি স্বভাবটিও তার বড় মিষ্টি। একা থাকতে থাকতে কা-স্নি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। প্রাসাদের সিংদরজার কাছে উ-ক্লিউকে দেখে তিনি খুব খুশি হলেন। নিজেই দরজার কাছে গিয়ে তিনি উ-ক্লিউকে স্বাগত জানালেন। আর উ-ক্লিউ যখন তার আগমনের কারণটা তাকে খুলে বলল, তখন তাঁকে দেখে কে? আনন্দে তিনি উ-ক্লিউকে জড়িয়ে ধরলেন।
ধূলি-ধূসর জগতের জীব উ-ক্লিউ হল এবার আলোর দেশের বাসিন্দা। পরমাসুন্দরী দেবকন্যা কা-স্নি তার সেবার জন্যে সদাই প্রস্তুত। এতে কোথায় সে বর্তে যাবে, নিজেকে ধন্য মনে করবে, কিন্তু তা হল না। নীলিমার দেশে এসেও উ-ক্লিউ তার স্বভাবটা একটুও পাল্টাতে পারল না—সব সময়েই সেই হামবড়া ভাব। যেন, কা-স্নিকে সে কৃতার্থ করে দিচ্ছে সেবা গ্রহণ করে। একটু এদিক-ওদিক হলেই অভদ্র ভাষায় গালি দিচ্ছে তাকে।
আগে কা-স্নি অজস্র রৌদ্রধারায় ভরিয়ে দিতেন পৃথিবীর মাঠঘাট। কিন্তু এখন উ-ক্লিউর সেবার কাজে তাঁকে সর্বদাই ওর কাছে কাছে থাকতে হয়। এরপর উ-ক্লিউ আবার ফতোয়া জারি করেছে যে, কা-স্নি আর আগের মতো হুটহাট বাইরে যেতে পারবে না। অর্থাৎ তিনি এখন নিজ-গৃহেই প্রায় বন্দিনি।
পৃথিবীর পশুপাখি-মানুষের কাছে এর ফল হল মারাত্মক। সূর্য আর আলো দেয় না, পৃথিবী ঘুটঘুটে অন্ধকার। প্রচণ্ড শীতে জর্জরিত পৃথিবী। বনের পাখিগুলির পাখা শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়তে থাকে। তাদের গলার গান গেল উবে, নীড়গুলো গেল ভেঙে। পক্ষীমাতার চোখের সামনেই তার সন্তানগুলি বৃষ্টিতে ভিজে মারা যেতে লাগল। মাঠে ধান প্রায় পেকে উঠেছিল, এখন রৌদ্রের অভাবে শুকিয়ে গেল। গাছের ফলগুলিও একে একে ঝরে পড়তে লাগল। পেটের খাবার জোটাতে না পেরে, পাখিরা একে একে মরতে শুরু করল।
সবকিছু দেখেশুনে বনের পাখিরা সবাই আবার একত্র হল। এবার তারা এল মানুষের কাছে। কেননা, তারা জানে জীবকুলে মানুষই সবচেয়ে বুদ্ধিমান। মানুষেরাও রৌদ্রের অভাবে কষ্ট পাচ্ছিল খুব, কিন্তু পেছনের কারণটা বুঝতে পারছিল না। এখন পাখিদের কাছে সব বৃত্তান্ত শুনে তারা তখনই এক সেরা গুণিনকে ডেকে রৌদ্র না-আসার প্রকৃত কারণ বাতলাতে বলল।
গুণিন বিচার সেরে জানিয়ে দিল, নীলিমার দেশে উ-ক্লিউর অবস্থানই এই অনাচারের আসল কারণ। ওই কদাকার পাখিটা সর্বদাই কা-স্নিকে আগলে বসে আছে। সুতরাং যতক্ষণ না ওকে পৃথিবীতে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে, ততক্ষণ জীবজন্তুদের দুঃখ ঘুচবে না।
গুণিনের কথা শুনে মানুষেরা পাখিদের বলল, জঙ্গলে কা-সাবুইট নামে এক বুদ্ধিমতী মহিলা আছেন, তোমরা তার কাছে গিয়ে তোমাদের দুঃখের কথা বলো, একমাত্র তিনিই পারেন ওই উ-ক্লিউকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে। পাখিরা জঙ্গলে খুঁজতে খুঁজতে এক সময়ে কা-সাবুইটের ডেরায় হাজির হল।
মহিলার তখন ভারী দুঃসময় চলছে। রৌদ্রের অভাবে চাষবাস বন্ধ। ঘরে কিছু সরষের বীজ মজুত আছে। কিন্তু বুনতে গেলে যদি পাখিরা খেয়ে ফেলে এই আশঙ্কায় এতদিন তিনি হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। আজ তার কাছে পাখিদের দলবেঁধে আসতে দেখে মনে মনে তিনি খুশিই হলেন। ওদের দুঃখের কথা শুনে বললেন, উ-ক্লিউকে আমি পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে পারি, তবে দুটি শর্ত আছে আমার।
—দুটি শর্ত? কী-কী শর্ত?
প্রথম শর্ত হল, আমার কিছু সরষের বীজ আছে, তা আমি জমিতে ছড়িয়ে দেবো, তোমরা সেই বীজ খেতে পারবে না। আমার দ্বিতীয় শর্ত হল, মাঠে ফসল ফললে যদি অন্য জন্তুরা তা খেতে আসে, তোমরা ঠুকরে ঠুকরে তাদের তাড়িয়ে দেবে। পাখিরা সমস্বরে জানাল যে তারা কা-সাবুইটের দুটি শর্তই অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে প্রস্তুত। পাখিদের কাছে অঙ্গীকার আদায় করে, কা-সাবুইট সোজা চলে গেলেন তার খেতে। সেখানে গিয়ে দিনের পর দিন মাটি খোঁড়া, জলসেচ আর জমির ওপর এক বিশেষ ধরনের আঁকিবুকি চলতে লাগল। প্রতিবেশীরা কা-সাবুইটের কাণ্ডকারখানা দেখে। আড়ালে হাসাহাসি করে। ভারী তো দুটো সরষে বুনবে, তার আবার এত ক্যারদানি কীসের?
এক সময়ে সরষের বীজ থেকে খেতে সবুজপাতাওয়ালা গাছ গজাল। সবাই লক্ষ করল খেতের মধ্যে সবুজ জায়গাটুকু একটি মেয়ের আকার ধারণ করল। শর্ত মেনে পাখিরা খেত পাহারা দিচ্ছে, কা-সাবুইট যত্ন ভরে আগাছা সরাচ্ছেন, জলসেচন করছেন। দেখতে দেখতে দিন কয়েকের মধ্যে খেতে ফুলের আগুন লাগল। উজ্জ্বল হলুদবরণ ফুলে চোখ ঝলসে গেল। মুগ্ধ প্রতিবেশীরা সেই দৃশ্য দেখে ধন্যি ধন্যি করতে লাগল। কিন্তু কা-সাবুইটের আসল মতলব তারা তখনও বুঝে উঠতে পারছিল না।
মাটির পৃথিবী ছেড়ে এবার নীলিমার দেশে উঁকি মারা যাক। দেখা যাক উ-ক্লিউ আর কা-স্নির দিনগুলি কেমনভাবে কাটছে সেখানে।
উ-ক্লিউর কাছে কা-স্নি খুব সহজেই ধরা দিয়েছিলেন বলেই বোধহয় উ-ক্লিউ মর্যাদা দিতে পারেনি তাঁর ভালোবাসার। সে অকারণ কা-স্নিকে গালি দেয়। মারধোর করে। কা-স্নি সবকিছুই নীরবে সহ্য করে যান। উ-ক্লিউ আসলে নিজেকেই এতটা ভালোবাসে যে অন্য কাউকে তার পক্ষে ভালোবাসা সম্ভব নয়। সে এমনই জালে জড়িয়েছে যে, নিজেই বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। কা-স্নিকে সে এত অত্যাচার করেছে, তবু কা-স্নি তাকে ছাড়ছেন না। তাঁর উপস্থিতি এখন উ-ক্লিউর কাছে অসহ্য ঠেকছে। আর ঠিক এ-সময়েই উ-ক্লিউর মন খুব ব্যাকুল হয়ে উঠল পৃথিবীর জন্য—প্রিয় জন্মভূমির জন্য। সে প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এক উঁচু ঢিবির ওপর বসে বসে যখন জন্মভূমির কথা, সঙ্গী পাখিদের কথা ভাবছে, ঠিক তখনই তার চোখ পড়ে গেল পৃথিবীর দিকে। সে অবাক হয়ে দেখল, এক হলুদবরণ সুন্দরী মেয়ে মাঠের ওপর শুয়ে আছে। তার রূপের ছটায় চতুর্দিক ঝলমল করছে। মেয়েটিকে দেখে উ-ক্লিউর কামনা যেন উছলে উঠল।
কা-স্নি কিন্তু সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলেন—এই স্বার্থপর হামবড়া আহাম্মক উ-ক্লিউকে। ভালোবাসা কখনই কোনো যুক্তির ধার ধারে না। তাই পদে পদে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়েও কা-স্নি আহাম্মক উ-ক্লিউকে নীলিমার দেশে থেকে যাবার জন্যে বারবার অনুরোধ করলেন। তাতেও যখন কাজ হল না বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে বাঁধতে চাইলেন।
তবু উ-ক্লিউকে আটকানো গেল না। কামনাতুর উ-ক্লিউ একদিন নীলিমার দেশ ছেড়ে পৃথিবীর দিকে উড়ে গেল। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র কা-স্নি তার পিছু নিলেন। তার চোখের জলে ভিজে গেল উ-ক্লিউর সারা শরীর। আর কী আশ্চর্য, তখন উ-ক্লিউর পাখায় ফুটে উঠল সাতরঙা রামধনুর রঙের বাহার। তার লম্বা লেজের ওপর পড়েছিল কা-স্নির চোখ থেকে বড় বড় কয়েকটা জলের ফোঁটা। সেগুলি উজ্জ্বল রঙের গোল গোল চিহ্নে পরিণত হল।
উড়ন্ত উ-ক্লিউকে কা-স্নি পেছন থেকে বলতে লাগলেন, ও গো, তোমার পাখায় আমি অনুরাগের লিখন এঁকে দিলাম—তুমি যেখানেই যাও, যাকেই ভালোবাসো না কেন—আমাকে ভুলতে পারবে না।
উ-ক্লিউ তো নীলিমার দেশ ছেড়ে পৃথিবীর বুকে নেমে এল। সকলে তার পাখার রঙের বাহার দেখে অবাক হয়ে গেল। উ-ক্লিউরও আনন্দ আর ধরে না। সে লেজ নেড়ে নাচতে শুরু করে দিল। এক সময়ে নাচ থামিয়ে অন্য পাখিদের সে দেমাকের সুরে বলল, আমি এখানে এক সোনার মেয়ের সন্ধান পেয়ে নীলিমার দেশ ছেড়ে এসেছি। তোমরা আমাকে সেখানে নিয়ে চলো।
উ-ক্লিউর কথা শুনে এবার অন্য পাখিদের হাসির পালা। তাদের তখন বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না যে, বোকা উ-ক্লিউকে ঠকাবার জন্যেই বুদ্ধিমতী কা-সাবুইট তার খেতে অত যত্ন করে নারীর আকারে সরষে বুনেছেন।
আসুন ময়ূরমশাই, আপনাকে আমাদের সোনার মেয়ের কাছে নিয়ে যাই—দুজনের মধ্যে আলাপ-পরিচয় হোক—এই বলে, ছোট পাখিরা হাসতে হাসতে উ-ক্লিউকে সরষে খেতের দিকে টেনে নিয়ে গেল। যেতে যেতে উ-ক্লিউ ব্যাকুল চিত্তে ভাবছিল, কখন সে মেয়েটির কাছে গিয়ে পৌঁছবে, আর তারপর পেখম তুলে কেকারব-সহ নাচতে নাচতে ঘুমন্ত সোনার মেয়েকে জাগিয়ে তুলবে। অকুস্থলে পৌঁছে সে নাচতে শুরু করল বটে—তবে তা আনন্দে নয়, ক্ষোভে।
লজ্জায়, অপমানে কাঁদতে কাঁদতে তখুনি সে স্থির করল—এই বজ্জাতদের দেশে আর এক মুহূর্তও সে থাকবে না। আবার সে ফিরে যাবে নীলিমার দেশে, কা-স্নির কাছে। উড়তে চেষ্টাও করল সে, কিন্তু পারল না। কিছুটা উড়েই ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। পৃথিবীর মাটি যেন সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে ধরেছে। ইচ্ছে না থাকলেও, বনের অন্য ছোট পাখিদের সঙ্গেই তাকে অবশিষ্ট জীবনটা কাটাতে হল।
কিরাত কাহিনি আমরা পড়লাম নলিনীকুমার ভদ্র-র ‘কিরাতী কাহিনী সপ্তক’ থেকে। উত্তর-পূর্ব ভারতের কিরাত পুরাণকাহিনি থেকে আমরা সোজা হাজির হতে পারি একটি প্রাচীন গ্রিক পুরাণ কাহিনির কাছে।
পৃথিবীর ফল ফসলের দেবী ডিমেটর। তাঁর মন সর্বদা ভরিয়ে রাখে তার মেয়ে পারসিফোন। সকালের রোদের মতো সে সুন্দর। প্রকৃতির প্রাঙ্গণে সর্বত্রই তার অবাধ গতি। সর্বত্রগামী সে। আপন মনে মেয়েটি ঘুরে বেড়ায় ফুলের বাগানে, পাহাড়ের ওপরে, ঝরনার ধরে। পাহাড়-ঝরনা-ফুলের বাগানও খুশি হয়ে তাকে দেখে। পারসিফোন যেখানে যায় সেই জায়গাটাই যেন রূপের ছটায় আলোকিত হয়ে ওঠে।
এহেন সুন্দরী পারাসিফোনের দিকে একদিন চোখ পড়ল প্লুটোর। প্লুটো হলো স্বর্গের জিউসের ছোট ভাই। প্লুটো পাতালের মৃত্যুলোকের অধিপতিও বটে। প্লুটোর পাতালের রাজ্য বহুরঙ্গশোভিত, কিন্তু বড়ই অন্ধকার সেই পাতালপুরী। প্লুটোর সাধ হলো—এই আলোককন্যাটিকে বউ করে নিয়ে গিয়ে তার অন্ধকার পাতালপুরীকে আলোকিত করেন। প্লুটো পাগল পারসিফোনের রূপে। মেয়েটিকে যেভাবেই হোক, পেতেই হবে। কিন্তু ঘটকালির কাজে কে তাকে সাহায্য করবে? দাদা জিউসের কথা একবার মনে হলো তাঁর, কিন্তু ওঁকে দিয়ে এ কাজ সম্ভব হবে না। ডিমেটরকে সবাই ভয় পান। দাদাও তাকে ডরান। কেউই ঘটকালির কাজে এগিয়ে এসে ডিমেটরকে চটাতে চাইবেন না। সুতরাং নিজের কাজ তাঁকে নিজেই নিতে হবে।
এক সুন্দর সকালে পারসিফোন মাঠে একা একা ভ্রমণ করছিল। বেড়াতে বেড়াতে সে একটা গাছের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। গাছের ডালে ফুটেছিল এক মস্ত বড় হলুদবরণ ফুল। অমন সুন্দর ফুল সে আগে কখনও দেখেনি। ফুলটা তুলতে গিয়ে আরও অবাক। ফুলটাই নয় শুধু, গোটা গাছটাই উপড়ে উঠল তার হাতের টানে। গাছটার শেকড়-বাকড় উঠে আসায় জায়গাটায় একটা গর্তও তৈরি হলো। ক্রমশ সেই গর্তের মুখটা বাড়তে আরম্ভ করল। বিস্ময়-বিস্ফারিত পারসিফোন দেখল, সেই গর্ত থেকে উঠে আসছে এক সোনার রথ। আর সেই সোনার রথে বসে-থাকা সোনার মুকুট-পরা এক কালো রঙের দেবতা। কোনো কিছু বোঝার আগে পারসিফোনকে প্লুটো টেনে তুলে নিলেন রথে। রথ আবার নীচের দিকে নামতে শুরু করল। ডিমেটর এক দণ্ডও থাকতে পারেন না মেয়ে ছাড়া। মেয়েকে দেখতে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে তিনি চারদিকে তল্লাসি শুরু করে দিলেন। রাগে কাপছে তাঁর সারা শরীর। পারসিফোনের শোকে সমস্ত গাছের পাতা ঝরে পড়ল। ফুলও আর ফুটল না। জুপিটার বুঝলেন, ডিমেটরের ক্রোধে বিশ্ব বোধহয় ধ্বংস হতে চলেছে। প্লুটোকে ডেকে পাঠালেন তিনি দেবদূত হারমিসকে দিয়ে।
পাতালে আসা পর্যন্ত পারসিফোন সর্বদা কেঁদেই চলেছে। যার উপস্থিতি মানেই ছিল আনন্দ, সে এখন বিষাদময়ী। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। প্লুটো তাকে কত অনুনয়-বিনয় করে, তোষামোদ করে। অনেক কাকুতি মিনতি করার পর পারসিফোন কিছু খেতে রাজি হলো। কিন্তু আশ্চর্য, ফল ছাড়া সে কিছু খায় না। প্লুটো তার সাগরেদদের পাঠালেন, পৃথিবী থেকে ফল জোগাড় করতে। কিন্তু পারসিফোনকে হারিয়ে তখন পৃথিবীর গাছে ফল শুকিয়ে গেছে। অনেক খুঁজে প্লুটোর সাগরেদরা একটা শুকনো ফল জোগাড় করতে পারল। সেই শুকনো ডালিমের এক চতুর্থাংশমাত্র খেতে পেরেছিল পারসিফোন।
ওদিকে জুপিটারের জোর তলব পেয়ে প্লুটো ছুটে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে। প্লুটোকে দেখে, জুপিটার আদেশ দিলেন, আর একটুও বিলম্ব না করে তুমি ডিমেটরের হাতে তার কন্যাকে ফিরিয়ে দাও, নইলে বিশ্বচরাচর অচল হয়ে যাবে। তবে একটা শর্ত জুড়ে দিলেন তিনি, যদি পাতালে পারসিফোন কিছু না খেয়ে থাকে, তবেই সে চিরতরে ফিরে যাবে। কিন্তু যদি সে কিছু খেয়ে থাকে, তবে যতটুকু পরিমাণ সে খেয়েছে, বছরের সেইটুকু সময় তাকে পাতালে থাকতে হবে।
জুপিটারের শর্তের কথা শুনে, প্লুটো মনে মনে খুশিই হন। কেননা তিনি জানেন পারসিফোন ডালিমের একের চার অংশ পাতালে খেয়েছে। সুতরাং সে-কথা জেনে, তাকে বছরের চার ভাগের এক ভাগ সময় পাতালে ফিরে আসতে হবে। প্লুটো তাই কথা না বাড়িয়ে পারসিফোনকে ফিরিয়ে দিলেন। সেই থেকে বছরে তিনমাস ডিমেটর মেয়েকে ছেড়ে শোকে কাতর হয়ে থাকেন। সে সময়ে গাছের পাতা ঝরে যায়, ঝরনার জল শুকিয়ে যায়, সূর্যের তেজ যায় কমে। প্রচণ্ড ঠান্ডায় পৃথিবীর মানুষজন এ-সময়ে ঠকঠকিয়ে কাঁপে। বছরের এই তিন মাস হলো শীতকাল।
ওপরে বলা কাহিনিটিতে দেবদেবীদের জায়গায় যদি রাজা-রানি-রাজকুমার-রূপকুমারীদের বসিয়ে দেওয়া যায়, তবে দেখা যাবে কাহিনিটি কী চমৎকার এদেশীয় রূপকথার আদল পেয়ে গেছে।
‘উ-ক্লিউ আর কা-স্নি’ এবং ‘ডিমেটর ও পারসিফোন’—এ কাহিনি দুটি পড়ার পর যদি কারো এমন মনে হয়, পারসিফোনের বছরে তিন মাস পাতালে থাকা আর লোকপুরাণে বলা গৌরীর স্বামীগৃহ থেকে পিতৃগৃহে ফিরে আসার কথা-র মধ্যে ফারাক বিশেষ নেই—বরং একই—তাহলে? পারসিফোনকে হারিয়ে প্রকৃতির বুকে পাতা ঝরে যাওয়া, ফুল না ফোটা, ঝরনার জল শুকিয়ে যাওয়া, রোদের তেজ কমে যাওয়া—এই বর্ণনার মধ্যে দিয়ে যে করুণ রাগিণী বেজেছে—এরকম পরিস্থিতি তো সব দেশের পুরাণ কাহিনিতেই দেখতে পাওয়া যায়!
‘উ-ক্লিউ আর কা-স্নি’র কাহিনিতে আমরা দেখি, উ-ক্লিউ স্বর্গ থেকে মর্ত্যের বুকে হলুদবরণ ফুল দেখে মোহিত হয়েছিল। আবার ‘ডিমেটর ও পারসিফোন’ কাহিনিতেও দেখি পারসিফোন হলুদবরণ ফুলে মুগ্ধ। দুজনের এই হলুদবরণ পুষ্পপ্রীতি কি নেহাতই কাকতালীয়—নাকি এর পেছনে গুঢ় কোনো তাৎপর্য আছে?
প্লুটোর পাতালপুরীর সঙ্গে যে বাংলার রূপকথার রাক্ষসপুরীর বেশ সাদৃশ্য আছে এ কথা না বললেও চলে। পারসিফোন যদি রূপকথার রাজকুমারী হয়, তবে প্লুটো অবশ্যই রূপকথার সেই প্রেমিক রাক্ষস—যে রাজকুমারীকে ভালোবাসে বলে সর্বদা তাকে কাছে রাখতে চায়, কিন্তু বল প্রয়োগ করে তার কোনো শারীরিক ক্ষতি করে না।
দূরবর্তী দুই দেশের পুরাণ কাহিনির মধ্যে এই মিল প্রথম চোখে পড়েছিল জার্মানির বিশিষ্ট লোককথা-সংগ্রাহক জেকব গ্রিম এবং ভিলহেল্ম গ্রিম ভ্রাতৃযুগলের। বিশেষত ভিলহেল্ম গ্রিমের। লোককথায় তুলনামূলক আলোচনার সেই সূত্রপাত। আরও পরে, ভিলহেল্ম গ্রিম নানা তথ্যের নিরিখে লোককাহিনিগুলির মধ্যে যে সাদৃশ্য দেখা যায়—তার একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খাড়া করার চেষ্টা করেন। তিনি দেখাতে চান লোককাহিনিগুলির এই পারস্পরিক সাদৃশ্যের মূলে আছে ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠী।
‘মানুষ যেখান থেকেই আসুক না কেন, তার আদিবাসভূমির স্মৃতি বহন করে বেড়ায়’—ভিলহেল্ম গ্রিমের এ-লোককাহিনির তত্ত্ব আসলে উপর্যুক্ত তত্ত্বেরই প্রতিধ্বনি করে। তবে তফাত এই, আমরা যা সাধারণভাবে সকল মানুষের লোককাহিনি সম্পর্কে বলতে চাই, তিনি তাকে ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন। ভাবখানা এই, ওই জনগোষ্ঠী ছাড়া পৃথিবীতে যেন আর কোনো জনগোষ্ঠী ছিল না। কিংবা থাকলেও, ইন্দো-ইয়োরোপীয় জনগোষ্ঠীই যেন তাদের সকলের একমাত্র মুখপাত্র। ভিলহেল্মের এই লোককাহিনি-পর্যবেক্ষণ ছিল একান্তই একদেশদর্শী, ফলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্দো-ইয়োরোপীয় তত্ত্বও হয়ে ওঠে রীতিমতো একপেশে।
দেশ-বিদেশের লোককাহিনির মধ্যে সাদৃশ্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এ-সময়ে ইন্দো-ইয়োরোপীয় তত্ত্বের পাশাপাশি পুরাণতত্ত্ব-এরও প্রচার চলতে থাকে। এই তত্ত্বেরও প্রবর্তক ছিলেন ভিলহেল্ম গ্রিম নিজেই। তিনি এ তত্ত্বের মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, পুরোনো দিনের মানুষের লোক-বিশ্বাসের কিছু কিছু অংশ সব লোককাহিনির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। পুরাণকাহিনি কালান্তরে হয়তো তার পূর্বমূল্য হারিয়েছে, কিন্তু লোককাহিনিকে সে মূল্যবান করে তুলেছে। তাঁর ধারণা হয়েছিল, পুরাণকাহিনি ভেঙেই লোককাহিনির উৎপত্তি।
বর্তমান সময় থেকে যতই আমরা অতীতের দিকে হাঁটব, ততই আমরা পুরাণ কাহিনির মহিমা উপলব্ধি করতে পারব। কল্পনাবলে পেছনে যেতে হলে, পুরোনো দিনের লোক-বিশ্বাস, লোককাহিনির অভিপ্রায় বা মোটিফগুলি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। ভিলহেল্ম গ্রিমের উদ্ভাবিত ইন্দো-ইয়োরোপীয় তত্ত্ব এবং ভেঙে যাওয়া পুরাণ তত্ত্ব দুটি বেশ কিছুকাল অবধি লোককাহিনি-গবেষকদের মনকে অধিকার করে ছিল। কিন্তু পরবর্তী কয়েক দশকেই এই তত্ত্ব দুটি তাদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য—দুই-ই হারিয়ে ফেলে।
বিশিষ্ট মার্কিন লোককথাবিদ স্টিথ টমসন ভিলহেল্মের তত্ত্ব দুটি লোককাহিনির আলোচনায় অফলপ্রসূ মনে করলেও, স্বীকার করেছেন যে, দুটি তত্ত্বের মধ্যেই বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল, যা পরবর্তীকালের লোককথা-আলোচনার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রচনা করেছে। তাঁর মতে, ভিলহেল্মের পর্যবেক্ষণেই প্রথম ধরা পড়েছিল যে, লোককাহিনির মধ্যে অনেক সাধারণ বৈশিষ্ট্য বারংবার পুনরাবৃত্ত হয়। যদিও পরবর্তীকালে ভিলহেল্ম বিষয়টি নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাননি। দ্বিতীয়ত, লোককাহিনি যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমাতে পারে, লোককাহিনির এই বৈশিষ্ট্যও ভিলহেল্মের অজানা ছিল না। কিন্তু লোককাহিনির এ-বৈশিষ্ট্যটিকেও পরবর্তীকালে তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করেছেন। অথচ ভিলহেল্মের পর্যবেক্ষণলব্ধ ওই দুটি সূত্র অবলম্বন করেই লোককাহিনির আলোচনা পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি লাভ করতে পেরেছে। লোককাহিনির মধ্যে আবৃত্ত বৈশিষ্ট্যগুলি মোটিফের সন্ধান দেয়। আর লোককাহিনি যে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘুরে বেড়ায়—এ-সত্যও আজ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
প্রচ্ছদচিত্র: www.pexels.com