আমরা লোকমুখে শুনছি, আর সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপন মারফতও জানলুম, ‘কলকাতা-৭১’ বিদেশী সমঝদারদের খুবই তারিফ পেয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রগল্ভ দিশি খবরের কাগজ এ-বিষয়ে মোটামুটি মৌন; আমাদের তারস্বর বেতারও এ-সম্পর্কে নির্বাক। এই অপূর্ব নীরবতার কারণ কী? ভেনিসে ঠিক কীরকম সম্মান পেল আপনার ছবি? ‘কলকাতা ৭১’-এর কোন কোন দিক বিদেশীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে বলে মনে হয়? এসব প্রশ্নের জবাবে নিজের কথা বলতে হবে বলে সংকোচ বোধ করবেন না। কারণ আমরা আপনার নিজের কথাই শুনতে উৎসুক।
ছবির যাবতীয় বিজ্ঞাপন করা হয়ে থাকে প্রযোজকের পয়সায়। স্বভাবতই বিজ্ঞাপনে প্রশংসার অংশটুকুই আপনারা পাবেন। নিন্দার অংশ সযত্নে সরিয়ে রাখা হয়, আপনারা তা দেখতে পাবেন না। এবং ছবির পরিচালক প্রযোজক পরিবেশকের সঙ্গে যে-সমস্ত কাগজওয়ালাদের মোটামুটি সদ্ভাব রয়েছে সে-সমস্ত কাগজের সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরাই নানাভাবে ছবিটির প্রচারকার্য চালিয়ে থাকেন। কাগজওয়ালারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই তা করে থাকেন। বড় কাগুজে সাংবাদিকদের অনেকের সঙ্গেই আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কমবেশি অস্বস্তিকর। ফলে, ওই ফ্রন্টে আমার তেমন কিছু হবে এমন মনে করবার কোনো কারণ নেই। আর বেতার? বেতার কি সর্বদাই সর্বক্ষেত্রে মুখর? এবং এক্ষেত্রে, ‘কলকাতা-৭১’-এর ক্ষেত্রে, বেতারের নীরবতার কথা যা বলছেন তার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে বলে আমি মনে করি না।
‘কলকাতা-৭১’ ভেনিস এবং পরে জর্মানির ম্যানহাইম-এ, সুইজারল্যান্ডের নিয়ঁ-তে এবং বার্লিন-এ অনেক বেশিই খাতির পেয়েছে। কিন্তু নিন্দিতও হয়েছে কোনো কোনো মহলে। সব মিলিয়ে হিসেবে যা দাঁড়ায় তাতে দেখা যায় প্রশংসার ভাগ বেশি। হ্যাঁ, বেশিই। ভেনিসে লক্ষ করেছি, ইংরেজ সমালোচকরা ছবিটিকে রীতিমতো অপছন্দ করছেন। তাতে প্রথমে কিঞ্চিৎ দমে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য নানা কথা মাথায় আসতে নিজেকে সামলে নিয়েছি এবং একদা ইংরেজ প্রভুদের ‘বংশধর’-দের উদ্দেশে কিঞ্চিতধিক বিষোদ্গারও করেছি। নিয়ঁ-তে অবশ্য সম্পূর্ণ অন্য চেহারা দেখেছি। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের এক দিক্পাল, একজন খাঁটি ইংরেজ, ছবিটি নিয়ে এতই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন যে ভিড়ের মধ্যে খুবই অস্বস্তিবোধ করছিলাম। নিয়ঁ-তে আরও কয়েকজন সমঝদার ইংরেজের নির্ভেজাল প্রশস্তি শুনেছি। বার্লিনে যাইনি। শুনেছি, খুব জমাট প্রতিক্রিয়া সেখানেও। তবে হ্যাঁ, নিয়ঁ-তে এবং বার্লিন-এ কয়েকজন ভারতীয় খুবই রুষ্ট হয়েছিলেন ছবিটি দেখে, দারিদ্র্যের এহেন কদর্যতা ওখানকার গুটিকয়েক প্রতিপত্তিশালী ভারত-সন্তানদের যৎপরোনাস্তি পীড়িত করেছিল। গ্ল্যামার লাঞ্ছিত দারিদ্র্যে অবশ্যই ভদ্রলোকদের কোনো আপত্তি থাকত না, কপট ক্রন্দনে অবশ্যই কিছুক্ষণের জন্যে আচ্ছন্ন বা অবশ হয়ে থাকতেন ওঁরা। কিন্তু যে দারিদ্র্যের উত্তরণ ঘটে ক্রোধে, সেই দারিদ্র্য চিত্রণ তাঁদের মানসিকতায় মহাপাপ বলে গণ্য এবং সেই দারিদ্র্য দর্শনে তাঁদের বড়ই লজ্জা।
‘কলকাতা-৭১’ যাঁদের ভালো লেগেছে ভেনিসে, ম্যানহাইমে, নিয়ঁ-তে ও বার্লিনে—তাঁদের কারো কারো সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনা হয়েছে, কারুর লেখাও বা পড়েছি। নানা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাঁরা ছবিটি দেখেছেন, নানাভাবে তাঁরা ছবিটিকে ব্যাখ্যা করেছেন। মোটামুটি ভাবে বলা যেতে পারে তাঁদের ভালো লেগেছে।
তাঁদের মতে, আমাদের দেশের বাস্তবতা এই ছবিতে ঐতিহাসিক পটভূমিকায় উপস্থাপিত হয়েছে। এ-হেন উপস্থাপন তাঁদের মতে বৈজ্ঞানিক মনেরই পরিচায়ক। তাঁরা খুশি, বাস্তবতার এ-জাতীয় চিত্রণে। অনেকেরই মতে এ ধরনের পরিবেশন—যা ‘কলকাতা ৭১’-এ হয়েছে, ভারতীয় ছবিতে তাঁরা আগে দেখেন নি; প্রচলিত রীতি থেকে ফর্মের এই মুক্তি প্রাপ্তি, তাঁদের মতে, ভারতীয় ছবিতে এই প্রথম। অনেকের ধারণা, ‘কলকাতা ৭১’-এর পরিচালকের মানসিকতায় রাজনৈতিক চেতনা সদা জাগ্রত। প্রাচ্যের সিনেমার ইতিহাসে এ একটি বড় ঘটনা, তাঁরা মনে করেন।
কথায় কথায় আমি যখন তাঁদের বলি যে, শিল্পকর্মীকে আজ প্রতিনিয়ত ঘটনার চাপে খানিকটা সোশ্যাল অ্যানথ্রোপোলজিস্টের ভূমিকা নিতে হবে, তখন তাঁরা আমার সঙ্গে পুরোপুরি একমত হন।
অন্যদিকে, ভেনিসে ছবি দেখে বিখ্যাত ইংরেজ সমালোচক জন কোলম্যান বলেন; ব্লেট্ন্ট ক্রুড অ্যান্ড… মনে নেই, কী যেন একটা খারাপ কথা লিখেছিলেন। কেউ বলেছেন অসহ্য, কেউ বা বলেছেন বিরক্তিকর। কেউ মন্তব্য করেছেন, হাই তুলতে ইচ্ছে করে… ইত্যাদি।
আপনার ছবি দেখে বিদেশী দর্শক আর দেশী দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায় কোনো তফাত লক্ষ করেছেন? একই জিনিস কী সব দেশের দর্শকদের নাড়া দেয়? একই ভাবে?
কী বলব? আমার বিচারবুদ্ধিতে তো একভাবেই নাড়া দেওয়া উচিত। তফাত যা হয় তা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে যেমন হয়ে থাকে। ‘কলকাতা ৭১’-এর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে, শুধু একটি বিশেষ অধ্যায় ছাড়া। ১৯৪৩-এর অধ্যায়, অঙ্গার-এর চিত্ররূপ যেখানে। বস্তির বৃষ্টি (১৯৩৩) এবং ট্রেনের ছেলেরা (১৯৫৩)-এর দুইটি অধ্যায় সম্পর্কে বিদেশের প্রায় সবাই উচ্ছ্বসিত, কিন্তু অঙ্গার সম্পর্কে কেমন যেন ঠান্ডা। বলে, ভালো! ওইটুকুই, ব্যস! দু-চারজনকে আমি জিজ্ঞাসাও করেছি, সদুত্তর তেমন একটা পাইনি। আলোচনায় টেনে এনে দেখেছি যে, সমস্যার গুরুত্ব তাঁরা বুঝতে পারছেন ঠিকই, তবু মনে হয়েছে, কেমন যেন আলগা ভাব। এমনও কি হতে পারে যে, বিষয়টি তাঁদের কাছে তেমন একটা বড় ব্যাপার নয়? তা মনে হয় না, একেবারেই না। মহিলাদের মধ্যে এমন অনেককে দেখেছি, যাঁরা বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন, নানা প্রশ্ন করেছেন আমাকে, বিশেষ করে নিয়ঁ-তে। কিন্তু সমস্ত মিলিয়ে বলতে বাধ্য হবো যে, অন্যান্য অধ্যায় সম্পর্কে বিদেশীদের যতখানি ইনভল্ভ হতে দেখেছি, ১৯৪৩-এর ঘটনা সম্পর্কে ততখানি ইনভল্ভ তাঁরা হতে পারেন নি। হয়তো হতে পারে সংলাপের ভেতরে তাঁদের অনেকেরই ঢুকতে অসুবিধে হয়েছে, হয়তো ফরাসি অনুবাদ (ছবিটিতে সাবটাইটেল ছিল ফরাসি ভাষায়) যে রকম হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। কারণ, আবার বলছি, আমার বিচারবুদ্ধিতে ১৯৪৩-এর ঘটনায় যে সমস্যা চিত্রিত হয়েছে, যে যন্ত্রণার কথা বলা হয়েছে তা পৃথিবীর কোথাও অজানা নয়, কোনো জাতিই এই অভিজ্ঞতা এড়িয়ে চলতে পারেনি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপ তো নয়ই।
আগে যে কথা বলছিলাম, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে প্রতিক্রিয়ায় যে ফারাক দেখা যায়—তা প্রায় সবটাই ব্যক্তির রুচি, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করি। এদেশ ওদেশের মধ্যে এক্ষেত্রে কোনো তফাত আছে বলে আমি মনে করি না। জন কোলম্যান যখন ‘কলকাতা ৭১’-কে বাতিল করে দেন এবং বেসিল রাইট যখন সেই ছবি নিয়েই মুখর হয়ে ওঠেন তখন এ কথা এক রকম হলফ করেই বলা সম্ভব যে, ‘জাতীয় বৈশিষ্ট্য’-র মাপকাঠিতে এই তফাতের হদিশ পাওয়া যায় না। এর হিসেব মিলবে একমাত্র ব্যক্তির নিজস্ব রুচি-শিক্ষা-অভিজ্ঞতায়, মিলবে ব্যক্তির নিজস্ব দর্শনে। এই দর্শনের অমিল কলকাতার দর্শকদের মধ্যে যেমন স্পষ্ট, বিদেশের দর্শকদের মধ্যেও তা উপস্থিত।
বিদেশে যখন আপনার শিল্প-সাধনা স্বীকৃতি পেল, তখন স্বদেশের পটভূমি মনে পড়া স্বাভাবিক। তাই জিজ্ঞেস করছি, সিনেমার ভাষা আন্তর্জাতিক ঠিকই; তা কি গণিতের ভাষার সমান আন্তর্জাতিক, না কবিতার ভাষার অনুরূপ? কবিতার শব্দে, শব্দ-বন্ধে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকে একটি সমগ্র জাতির স্মৃতি, ইতিহাস, ভাব-ভাবনার অনুষঙ্গ—সমস্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। ফিল্মের ভাষাতেও কি এসব গেঁথে গেঁথে যায়?
যদি আপনার প্রশ্ন ঠিক বুঝে থাকি: আগের প্রশ্নে আপনার জিজ্ঞাস্য ছিল জাতি বা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দর্শকের মানসিকতাকে প্রভাবিত করে কিনা, এবং করলে কতখানি। বর্তমান প্রশ্নে আপনার জিজ্ঞাস্য, চিত্রনির্মাতার ওপর উপরোক্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কতখানি কার্যকর এবং চিত্রনির্মাতা এই ঐতিহ্যকে আদৌ এড়িয়ে চলতে পারেন কিনা; এই তো?
আগের প্রশ্নের জবাবে আমি বলতে চেষ্টা করেছি যে, একই দেশের মানুষ একই সাংস্কৃতিক পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েও একই ঘটনায় বিভিন্নভাবে রিঅ্যাক্ট করে থাকেন। অন্তত আমার ছবির ক্ষেত্রে আমি তাই দেখেছি এবং সেই কথাই আমি বলেছি। এ-দেশের মানুষ হিসেবে আপনিও নিশ্চয়ই তা লক্ষ করেছেন এবং করে চলেছেন প্রতিমুহূর্তে। অতীতে, অনেক আগে, একই দেশের মানুষের মধ্যে এতখানি মতপার্থক্য তেমন করে স্পষ্ট হয়ে উঠত কিনা আমার জানা নেই। হয়তো নয়। হয়তো পার্থক্য তখন প্রকট হয়ে উঠত দেশ থেকে দেশে, গোষ্ঠী থেকে গোষ্ঠীতে, শ্রেণি থেকে শ্রেণিতে। হয়তো মত তখন গড়ে উঠত, আপনারই ভাষায়, দেশের বা জাতির স্মৃতি, ইতিহাস, ভাব-ভাবনার ‘বিশুদ্ধ’ পথ বেয়ে। ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ মারফত যা তখন পাওয়া যেত অথবা প্রতিফলিত হত সেকালের দর্শনে, হয়তো সেগুলোর একটা ‘দেশজ’ চেহারা ছিল। কিন্তু আজ, এই বিজ্ঞানের যুগে, যখন সময় ও ভৌগোলিক দূরত্বের ফারাক অস্বাভাবিক গতিতে ছোট হয়ে আসছে, যখন সভ্যজগতের কোথাও সাংস্কৃতিক জীবন—সোশ্যাল অ্যানথ্রোপোলজিস্টের ভাষায় আর ‘ভার্জিন’ থাকতে পারছে না, অর্থাৎ যখন আমরা, পৃথিবীর সবাই মোটামুটি কমবেশি মিশ্র-সংস্কৃতির আওতায় এসে পড়ছি, তখন আমাদের, আধুনিক মানুষের চিন্তায় ভাবনায় দর্শনে আমরা এই মুহূর্তে, কতখানি ‘বিশুদ্ধ’ থাকতে পারছি তা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে আরও বলব: এই মুহূর্তে, বর্তমান জগতে টেকনোলজির এই অগ্রগতির মুখে ‘বিশুদ্ধ’ থাকার জন্যে লড়াই করবার আর প্রয়োজন আছে কি? যা-হোক, আপনার বর্তমান প্রশ্নে আসা যাক।
নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে, গত শতাব্দীতে একসময়ে বিশুদ্ধ ছবি আঁকিয়েরা ফোটোগ্রাফিকে বড়ই ছোট নজরে দেখতেন, ভাবতেন, ব্যাপারটা একেবারেই যন্ত্রসর্বস্ব এবং সে কারণে শিল্পরস সঞ্চারে অপারগ। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, ফোটোগ্রাফি নামক বস্তুটি যন্ত্র ও রসায়নশাস্ত্র দ্বারা চালিত হয়েও রীতিমতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। দেখা গেল ফোটোগ্রাফার তাঁর বিচারবুদ্ধি ও কলাকৌশল প্রয়োগ করলেন তাঁর কাজে, যান্ত্রিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করলেন তাঁর রুচি ও বোধ অনুযায়ী, লাইন এবং টোনের বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে শিল্পসমৃদ্ধ করে তুললেন ফোটোগ্রাফিকে। এখন প্রশ্ন করব, ফোটোগ্রাফির মধ্যে কি কেউ কখনও জাতির ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’-র ছোঁয়াচ পাবেন? যদি কেউ মনে করেন, পাবেন, তাহলে জিজ্ঞেস করব, ফোটোগ্রাফির লিনিয়ার এবং টোনাল কম্পোজিশনে কেউ কি কখনও ‘দেশজ’ গন্ধ আবিষ্কার করতে পেরেছেন?
বিজ্ঞানের এই শাখারই পরবর্তী ধাপ হলো মুভিং পিকচার্স, অর্থাৎ চলচ্চিত্র। তার বেশ কিছুদিন পরে এই চলমান চিত্রে সংযোজিত হলো শব্দ। এবং এই দুইয়ের সংমিশ্রনে যা দাঁড়াল তাকেই আজ বলে থাকি ফিল্ম। অর্থাৎ আজ ফিল্ম বলে যে-বস্তুটিকে আমরা বুঝি সেই বস্তুটি অনেকাংশেই একটি টেকনোলজিকাল পারফরমেন্স—যার গঠনপদ্ধতি ফোটোগ্রাফি ইত্যাদির চেয়ে ঢের বেশি জটিল এবং শিল্পমাধ্যম হিসেবে যার সম্ভাবনা প্রচণ্ড।
ফোটোগ্রাফি সম্পর্কে আমার যা বক্তব্য, অবশ্যই বুঝতে পারছেন, ফিল্মের গঠনপদ্ধতি সম্পর্কেও আমি প্রায় সেই কথাই বলব। এবং প্রশ্ন করব: ফিল্ম বলতে যতটুকু টেকনোলজিকাল পারফরমেন্স বুঝি তার মধ্যে কেউ কি বিশেষ কোনো জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ছোঁয়াচ পাবেন? কোনো ‘দেশজ’ গন্ধ? আঞ্চলিক আমেজ?
অবশ্যই, অ্যাটমিক রিঅ্যাক্টর যে-অর্থে টেকনোলজিকাল পারফরমেন্স সেই অর্থে ফিল্ম তা নয়। এখানে টেকনোলজির ওপর প্রতি মুহূর্তে যার খবরদারি চলে, তার নাম মন। মনের রকমফের আছে, অতএব টেকনোলজির ব্যবহারেও। যদি বলেন, এই ব্যবহারিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই জাতীয় চরিত্রের আন্দাজ পাওয়া যায়, আমি তা মানতে নারাজ। ভারতীয় ফিল্মের গতি, প্রায়ই দেখতে পাই, অতিমাত্রায় মন্থর। কেন? অনেকের মতে, ওটাই নাকি ভারতীয় ট্রাডিশনের একটি বিশিষ্ট দিক। তাই যদি হয়, ব্রেসঁ-র ফিল্ম দেখে কী বলব? আমরা জানি, জাপানিদের বসবার একটা প্রাচীন রীতি আছে—হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসা। ওজুকেও দেখেছি, মাটিতে ক্যামেরা বসিয়ে ছবি তুলেছেন। অনেকে বলে থাকেন, ওইভাবেই নাকি ওজু তাঁর ছবিতে ‘জাপানি গন্ধ’ ছড়াতে পেরেছেন। কিন্তু জাপানি পোশাকে সাজিয়ে কোনো জাপানি মেয়েকে যদি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে ক্যামেরায় ধরা যায়? অথবা মাটিতে ক্যামেরা বসিয়ে যদি সাঁচির ফটকের ছবি তোলা হয়? অথবা এথেন্সের কোনো প্রাচীন মহিমার? কিংবা কার্থিজের কোনো ভগ্নস্তুপের? এসবের কোনো কিছুতেই কী কোনো অর্থ আরোপিত হয়? কোনো দেশ বা জাতির সত্তারূপের সন্ধান পাওয়া যায় কি এসবের মধ্যে দিয়ে?
এ কথা সত্যি যে ইন্দির ঠাকরুনের মুখের গঠনে, বাচনে বসনে, তাঁর গ্রামীণ পথ পরিক্রমায় এবং তাঁর গল্প বলার ঢং-এ গ্রাম বাংলার এক নিখুঁত শারীরিক অস্তিত্ব ধরা পড়ে। এবং এও সত্যি যে, সত্যজিৎ রায়ের মতো দনস্কয়ও আমাদের সামনে হাজির করেছেন ম্যাক্সিমোভিচের দিদিমাকে—যাঁর গঠন, বাচন, বসন, পথ পরিক্রমা ও গল্প বলার ঢঙের মধ্য দিয়ে, আমরা পরিষ্কার দেখেছি, সেকেলে রুশ সমাজের একটি শারীরিক চেহারা। কিন্তু শারীরিকতার এই যে ফারাক, তা কি ফিল্মি ভাষার প্রসাদ গুণে? আমি বলব, ভাষায় নয়, এই ফারাক আমরা দেখতে পাব পারিপার্শ্বিকের শরীরে, দৃশ্যবস্তুতে ও শব্দে। ইন্দির ঠাকরুন ও ম্যাক্সিমোভিচের দিদিমার মুখের গঠনে, বাচনে, বসনে তাঁদের এনভায়ারমেন্টাল রিয়ালিটিতে। বাকি যে তফাতটকু আমাদের নজরে পড়ে তা সত্যজিৎ রায় ও দনস্কয়ের ব্যক্তিমানসে ও তাঁদের নিজস্ব স্টাইলে।
আরও বলি। আমার এক কবি বন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ছেলেবেলার অপুর মানসিক জগৎ একান্তভাবেই ভারতীয়। তর্ক তুলব না, কিন্তু মনে পড়ে অপুর বয়সি আর একটি ছেলেকে আমরা দেখেছি—‘লুইসিয়ানা স্টোরি’-তে (ফ্লাহার্টির শেষ ছবি; ১৯৪৮)। জিজ্ঞাসা করব, এই দুটি ছবিতে ফিল্মি ভাষার তফাত কি খুব একটা দেখতে পেয়েছেন? এবং ঐতিহ্যের শাসন?
‘সুবর্ণরেখা’র কথা ভাবুন। সেই মেয়েটি, সীতা যার নাম, শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে গল্প শুনতে শুনতে এগিয়ে চলেছে, রামায়ণের গল্প সম্ভবত! বোমার মতো ফেটে হঠাৎ আবির্ভাব বিকট-দর্শন কালীমূর্তির সমস্ত পর্দা জুড়ে। মেয়েটির ভয়ার্ত মুখ। ছবি শব্দ সমস্ত মিলিয়ে মুহূর্তের জন্যে দর্শকেরও বুকের ধুকধুকি বন্ধ হয়ে যায়। মুখোশের আড়াল থেকে বহুরূপীর মুখ বেরিয়ে আসে, হাসছে বহুরূপী। আবার সব ঠিক, যেমন ছিল। একটি অসাধারণ মুহূর্ত, অর্থবহ, তাৎপর্যে ঠাসা এক প্রতীকী ব্যঞ্জনা, একান্তভাবেই ফিল্মের ভাষায় বিধৃত। কিন্তু এই নিয়ে যদি কোনো শিল্পরসিক ভারতীয় সত্তারূপের উৎস সন্ধানে প্রবৃত্ত হন এবং তাই করতে গিয়ে উৎকট রকমের বাড়াবাড়ি করেন (আদ্যাশক্তি ইত্যাদি) তাহলে অবশ্যই তাঁকে আমি হিন্দু শভিনিজ্মের দায়ে অভিযুক্ত করতে রাজি আছি।
তাই বলি, যখন দেখছি, পৃথিবী এগিয়ে চলেছে দুর্বার বেগে, দেওয়ালের পর দেওয়াল যখন ভেঙে চলেছে আধুনিক বিজ্ঞান, চাঁদের চরকা-কাটা বুড়ি যখন চাঁদের দেশ থেকে বিতাড়িত, মিথ যখন ভাঙছে অথবা সার্বিক হয়ে উঠছে, যখন দেখি সাহারা বা সাইবেরিয়ার মাটিতে ফসল ফলাচ্ছে আজকের মানুষ। যখন সারা পৃথিবী জুড়ে সংস্কৃতির আসরে ক্রস-ফার্টিলাইজেশ্ন চাষ হচ্ছে অপ্রতিহত গতিতে, সেখানে স্বতন্ত্রীকরণের প্রাণান্তকর এই চেষ্টা কেন? এই চেষ্টা কি কষ্টকল্পিত নয়? আজকের এই বৈজ্ঞানিক আবহাওয়ায়?
ভাষার স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের সেই মন্তব্যটি মনে পড়ছে, ‘স্বতন্ত্র আছে বলিয়াই রক্ষা।’ কথাটা আজ যেন কেমন সেকেলে মনে হয়। জানি না, আপনাকে চটিয়ে দিলাম কিনা। কে জানে, হয়তো আমাকে কসমোপলিটিজ্মের দায়ে অভিযুক্ত করবেন।
মৃণাল সেন-কে ‘দৃশ্য’ পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রশ্নগুলি করেছিলেন প্রাবন্ধিক প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য।
‘দৃশ্য’, সংখ্যা ১৬, জানুয়ারি ১৯৭৩
প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.britannica.com