[নাদিন গর্ডিমার সম্পর্কে নতুন করে পরিচিতি দেবার প্রয়োজন পড়ে না। দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের সহযোগী, সহমর্মী শ্বেতাঙ্গ নাদিন গর্ডিমার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপক। বর্ণবৈষম্যের তীব্র প্রতিবাদে প্রতিরোধে তিনি ছিলেন সদা-জাগর ব্যক্তিত্ব। বলা হয়, এই প্রেক্ষিতে তিনি ছিলেন যেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিবেক। নেলসন ম্যান্ডেলা, ডেসমন্ড টুটুর আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য নাদিন গর্ডিমার বোথা সরকারের নিপীড়ন ও অত্যাচারের ভয়ে ভীত হয়ে কোনোদিনও দেশ ত্যাগ করেননি। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরেক নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত আয়ারল্যান্ডের কবি সিমাস হিন্রী বলেছিলেন, ‘দ্য গেরিলা অব্ দ্য ইমাজিনেশন’। নিবন্ধটি তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘টেলিং টাইম’ (১৯৫৯) থেকে গৃহীত। বঙ্গানুসরণের ক্ষেত্রে নাদিনের লিখনশৈলীর (যা যথেষ্ট সুখপাঠ্য নয়) বৈশিষ্ট্যকে বজায় রাখা হয়েছে।]
বঙ্গানুসরণ : বিকাশ শীল
মানুষেরা ভ্রাতা হিসাবে জন্মায় না, তাদের একে অপরকে সেভাবে আবিষ্কার করে নিতে হয় আর এই আবিষ্কারকেই বর্ণবৈষম্যবাদ আটকাতে চায়…বর্ণবৈষম্য আদতে কী!
সেটা নির্ভর করছে কে উত্তর দিচ্ছেন। যদি আপনি দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের কোনো আধিকারিককে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি তখন আপনাকে জানাবেন, এই নীতি সাদা ও কালোর মধ্যে একটা স্বতন্ত্র ও সমান্তরাল ব্যবস্থা—এইটা হলো সরকারি এবং প্রচলিত আইনানুগ সংজ্ঞা। আর আপনি যদি এই ব্যবস্থার সমর্থক একজন সাধারণ সাদা মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি বলবেন, এই নিয়মাবিধির মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার সাদাদের অধিকার সুরক্ষিত রাখতে চায়। আবার আপনি যদি কোনো কালো মানুষকে প্রশ্ন করেন, তিনি হয়তো এগারো-বারোটা উত্তরের মধ্যে কোনো একটা জানাবেন যেটা সেদিনই তিনি মোকাবিলা করেছেন। কারণ তার ক্ষেত্রে বর্ণবৈষম্য মোটেই একটি আদর্শগত ধারণা নয়। বরং এই নিয়মনীতির জন্য তাদের শিক্ষা, কর্ম, প্রেম-প্রণয় ইত্যাদি সমস্তটা জুড়ে সারা জীবনটাই ঋজুভাবে অবরুদ্ধ।
তিনি আপনাকে অনেকগুলো বিধিনিয়মের কথা বলবেন যার জেরে যে-কোনো সভ্য মানুষের অতি সাধারণ চাওয়াপাওয়া বেআইনি বলে চিহ্নিত, তবে সেই একই চাহিদা কিন্তু সাদা মানুষের কাছে সহজেই লভ্য। যদিও সব সময় সেটা সম্ভব হয় না। সেই মুহূর্তে কালো মানুষটির কাছে যে সমস্যাটা জরুরি তা হলো জলে-যাওয়া ‘রাষ্ট্র শিক্ষাব্যবস্থা’ থেকে তার শিশুকে কীভাবে বাঁচাবেন—এই ব্যবস্থাটা স্কুলে কালো ছেলেদের জন্য সাধারণভাবে সুলভ—সিলেবাস কমিয়ে দিয়ে, নিম্নস্তরের শিক্ষাদান। কারণ সাদা শিশুদের মতো কালো শিশুরা নাকি সমপর্যায়ের শিক্ষা পেতে পারে না। কালোরা বরং হাতের কাজ বা ভৃত্য সংক্রান্ত কাজকর্ম শিখুক। কখনও আবার আপনি সকালে জনৈক কালো মানুষের দেখা পেলেন, যিনি সারারাত্রি পুলিশ হাজতে কাটিয়ে সেই মাত্র ছাড়া পেয়েছেন; তার অপরাধ রাতে কারফিউ সময়ের মধ্যে রাস্তায় বেরিয়েছেন এবং তার কাছে কোনো সাদা মানুষের সই করা ছাড়পত্র ছিল না। এ জন্য হয়তো (যদি কালো মানুষটি তেমন আগ্রহী হন) তিনি রেগে গেলেন কেননা তিনি একটা গানের অনুষ্ঠান শুনতে পেলেন না কিংবা (তিনি যদি তেমন মানুষ হন, কেই বা হন না!) এক বোতল ব্র্যান্ডির জন্য তাকে কালোবাজারের দাম দিতে হলো কারণ তার পক্ষে, ব্র্যান্ডি কেনা আইনত দণ্ডনীয়। তার কাছে এসবই হলো বর্ণবৈষম্য। অনেক অনেক এমন সব ছোটো বড়ো ঘটনা মিলিয়েই বর্ণবৈষম্য।
যদি আপনি জানতে চান দক্ষিণ আফ্রিকায় কালো মানুষেরা কীভাবে বেঁচে থাকেন, তাহলে আপনাকে বর্ণবৈষম্যের সক্রিয় পরিস্থিতির বাস্তবটা জানতে হবে কারণ কালো মানুষের সারা জীবনটায় সাদা মানুষের নিয়মিত প্রত্যাখ্যানই প্রকৃত ব্যবস্থা। এই প্রত্যাখ্যান দিয়েই বর্ণবৈষম্যের আরম্ভ, নিয়মাবিধি আইনে পরিণত হওয়ার আগেই নির্বাচিত বর্ণের তত্ত্ব নির্ধারিত হয়ে যায়। আফ্রিকান ন্যাশনালিস্ট (শ্বেতকায় তবে উৎস ডাচ কিন্তু তার মাতৃভাষা আফ্রিকান;—একজন ন্যাশনালিস্ট ন্যাশনাল পার্টির সদস্য বা সমর্থক, বর্তমানে যারা সরকারে আছেন) বর্ণবৈষম্য তত্ত্বটি আবিষ্কার করেনি, তারা তত্ত্বটিকে কেবলমাত্র বিস্তার করেছে এবং কেনের যে প্রেরণা নিয়ে তারা কাজে তৎপর, সেটা দক্ষিণ আফ্রিকার বহু সাদা মানুষের ভেতর আছে, ইংরাজি-ভাষী ও আফ্রিকা-ভাষী দুই তরফেই।
আমি কি ভুলে গেছি, আমার শিশু বয়েসে আমাদের শেখানো হতো যে আমি যেন কখনও কালো দাসের ব্যবহৃত কাপ ব্যবহার না করি!
দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বড়ো শহর—সাদা শহর—জোহানেসবার্গে আমি বাস করি। এই সাদা শহরটিকে ঘিরে, বিশেষত উত্তর-দক্ষিণে আরেকটি শহর, কালো জোহানেসবার্গ, আছে। আর এই নির্দিষ্ট সাদা কালো বিভাজনের পরিধিতে আবছাভাবে একটা ছোটো মিশ্র রঙের মহল্লা আছে—মিশ্র রক্তেরও—এরা ভারতীয় গোষ্ঠী—এরাও একে অপরের থেকে পৃথক। পৃথক অবশ্যই সাদাদের থেকেও এরা এখানেই বসবাস করে। যদিও আপনি সাদা শহরের প্রতিটি সাদা পরিবারে কালোদের দেখতে পাবেন, তবে তারা কিন্তু দাস আর প্রত্যেক পরিবারে দাসেদের জন্য পৃথক ঘর থাকে—ঘরগুলো সাদাদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে—আলাদা জায়গায় থাকে। অভিজাত আফ্রিকাবাসীরা আবার এই পিছনের ঘরগুলোর বাসিন্দাদের ‘কুকুরের মাংস খেকো’ বলে উল্লেখ করেন, কারণ ঘরগুলো মানুষের থেকে দূরে কুকুরের ঘরের কাছাকাছি হয়।
তবে সাদা শহরে কোনো কালো মানুষের বাড়ি নেই। নেই কোনো সম্পদ, সম্মান, নেই কোনো ধরনের বিশিষ্টতা যার জোরে সে, আমি যেখানে বাস করছি বা যে-কোনো সাদা মানুষ বাস করছে, সেই পাড়ায় উঠে আসতে পারে। সুতরাং একজন কালো মানুষের সঙ্গে সামান্যতম যোগাযোগ ছাড়াই হাজারো সাদা মানুষ তাদের সারা জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারে। যদিও কালো মানুষদের নিজস্ব সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থান আছে তবু তাদের সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদাদের চাকরবাকর বা ‘বয়’ হিসাবেই দিনগুজরান করতে হয়—তারা জিনিসপত্র জোগান দেয়, ঠেলাগাড়ি চালায়—মুদির কর্মী, কসাইয়ের কর্মী, গোয়ালার কর্মী, ধাঙড় ইত্যাদি। এই প্রেক্ষিতে দেখবেন সাদা নারী-পুরুষদের সাধারণ ধারণা হয় যে কালোরা নিশ্চিতভাবেই নীচু স্তরের জাত। এমন অভিজ্ঞতা থেকে বর্ণবৈষম্য নিয়ে গালভরা বুলি অনিঃশেষ হয়ে ওঠে, যেন বা একটা শাঁখের খোলের কণ্ডলী থেকে একটা মেকি সাগর তৈরি হয় : কালোরা শিশুর মতো…সাদাদের মতো তারা চিন্তাভাবনা করতে পারে না…তারা তৈরি নয়।
সমস্তরকম কায়িক পরিশ্রমের কাজকর্ম কালোরাই করে কারণ সাদারা রাস্তা খোঁড়া বা ট্রাকে মাল তোলা-নামানো ইত্যাদি কাজ করতে চায় না। আবার যেসব কাজ সাদারা করতে ইচ্ছুক, সে সব কাজেও সাদাদের জন্য সংরক্ষণ থাকে, সে সব কাজ কালোদের পক্ষে অনুমতি সাপেক্ষ অর্থাৎ এভাবে কাজ থেকে ইচ্ছুক কালোদের দূরে রাখা হয়। নির্মাণশিল্প এবং তৎসংক্রান্ত কাজে কালোরা অদক্ষ বা অল্পদক্ষ শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে পারে কিন্তু আইনগত ভাবে তারা আর কিছু পেতে পারে না। তারা দোকানের কাউন্টারে কাজ করতে পারে না, সাদাদের পাশাপাশি থেকে কোনো কাজই তারা পেতে পারে না। কালোরা যেখানেই কাজ করুক, সেখানে তারা সাদা শ্রমিকদের ক্যান্টিন বা বাথরুম ব্যবহার করতে পারে না। অবশ্য তারা দোকানে জিনিসপত্র কেনাকাটা করতে পারে। এক্ষেত্রে কিন্তু বর্ণবৈষম্য ভুয়ো হয়ে পড়ে যখন সাদা দোকানির কাছে জনৈক কালো ক্রেতা হাজির হয়। বর্ণবৈষম্য তখন নীরব থেকে ক্রেতাকে বাজারের সমৃদ্ধ দ্রব্য বেচার জন্য উদ্গ্রীব হয়—তখন সাদাদের মতো কালোরাও নাকি ভালোরকম চিন্তাভাবনা করতে পারে, সাদাদের পছন্দমতো জিনিস পছন্দও করতে পারে—এলপি রেকর্ড থেকে নো-আয়রন শার্ট ইত্যাদি।
যে-কোনো একটা গোষ্ঠী মানুষের প্রকৃত জীবন—হোটেল, রেস্তোরাঁ, পানশালা, ক্লাব, কফিবার—সেখানে কালো আফ্রিকানদের জায়গা নেই। অথচ এইসব প্রতিষ্ঠানে কালোরা কাজ করে, কিন্তু এসব জায়গায় ঢুকতে পারে না, বসতে পারে না টেবিলে। সিনেমা হল, আর্ট গ্যালারি, থিয়েটার হল, গল্ফের মাঠ, খেলাধুলোর ক্লাব, এমনকি লাইব্রেরির দরজা পর্যন্ত কালোদের জন্য বন্ধ। পোস্ট অফিস এবং নানা সরকারি অফিসে কালোদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থা আছে। কালোদের কোনো ভোটাধিকার নেই।
যেদিন থেকে আপনি কালো হয়ে জন্মেছেন আর যেদিন আপনার মৃত্যু—এই সময় পর্বে এমন জীবনযাপন আসলে কেমন জীবনযাপন, আমি তা বলতে পারি না। কোনো সাদা মানুষ পারেন না বোধহয়! মনে হয়, আমি আমার কয়েকজন কালো বন্ধুর জীবন জানি, কিন্তু বারবার আমি দেখতে পাই, ধরে নিচ্ছি—যেহেতু এটা গড়পড়তা সাদা মানুষের জীবনের অংশ—অর্থাৎ তাদের সাধারণ অভিজ্ঞতাটা জানা আছে—বস্তুত সেরকম কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমি কেমন করে স্মরণ করি, ড্যানি, যিনি ব্যবসায়িক মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা সন্দর্ভ লিখেছেন, তিনি কোনোদিন জাদুঘরের ভিতরে যেতে পারেননি? কীভাবে স্মরণ করি, জন, যিনি একটি সুন্দর কাগজের সাংবাদিক, কোনোদিন আশা করতেই পারেন না আমার অনুরুদ্ধ সিনেমাটা দেখার, যেহেতু ছোটো শহরের সিনেমা সেন্সর করা হয় এবং সাবালক ছবি দেখানো হয় না। আমি কেমন করে স্মরণ করি যে, এলিসের চমৎকার শিশুরা যারা আমার নিজের শিশুর খেলনা হাতি নিয়ে খেলা করে, তারা কিন্তু জোহানেসবার্গ চিড়িয়াখানায় কোনোদিন হাতি চড়তে পারে না। কালো হওয়ার জন্য শ্রমিকরা অতি তুচ্ছ নীচু জীবনযাপন করে। শ্রমিক যদি সাদা হয় অন্ততপক্ষে তার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষায় কোনো বাধা আসবে না। কিন্তু শিক্ষিত মানুষটি যদি বর্ণের অন্য দিকে থাকেন, মানে উন্নত হতে চান, তাহলে যতই তিনি শিক্ষিত হন না কেন, তিনি সমাজে সামান্য ভূমিকা পালন করতে পারবেন না, বরং মানুষ হিসাবে তিনি একজন শিশু বা পাগল বলে চিহ্নিত হবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের বাইরে (অতি শীঘ্র তিনি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ঢুকতেই পারবেন না, কারণ দুটো মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে আইন মোতাবেক কালোদের পক্ষে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে) সাদারা সেই কালো ছেলেটিকে ‘বয়’ বলে অভিনন্দন জানাবে। ১৯৫৬, যখন প্রথম আফ্রিকার কালো অ্যাডভোকেট, জোহানেসবার্গে বারে নিযুক্ত হন, তখন সাদা সরকারি আধিকারিকরা তাদের চেম্বারে ওই কালো অ্যাডভোকেটটির সামলা পরা ও খোলায় আপত্তি জানায়। তার সহকর্মীরা তাকে আইনের লোক বলে গ্রহণ করলেও বর্ণবৈষম্যের জন্য তিনি চিহ্নিত হয়ে যান। প্রতিভা বলুন, বুদ্ধি বলুন দেবদূত হন বা ঠগি হন, দক্ষিণ আফ্রিকায় কোনোভাবেই একজন কালো মানুষ সাধারণ মানুষের ন্যূনতম অধিকার অর্জন করতে পারে না।
দক্ষিণ আফ্রিকার কালোরা তাদের মতো করে এক ধরনের জীবনযাপন করে নিশ্চয়। তাদের জীবন বস্তি-জীবন, একটা বানানো ব্যবস্থা, কেননা যদিও আমি সাদা শহরের বাইরে অবস্থিত কালো শহরের কথা বলছি, এইসব কালো-শহরগুলো ছোটো শহর বা মফস্সল বলে চিহ্নিত—এগুলো হারলেম ছিল না। মিউনিসিপাল বাড়িঘর ছিল একইরকমের আয়তকার গোমড়া চেহারার আর ধোঁয়াটে নড়বড়ে ভাঙা ইট ও টিনের ঘর—রাস্তায় আলো খুব কম, দোকান মাত্র কয়েকটি। এখানে জীবন উদ্দাম, অশ্লীল, খোলামেলা। সমস্ত রকমের মানুষিক আদানপ্রদানের প্রকাশ মিশুকে ধরনের—একটা নোংরা গলিতে দাঁড়িয়ে আপনি দারুণ উত্তেজক প্রাণপ্রাচুর্য অনুভব করবেন। এখানে সেখানে ছোটো ছোটো ঘরে যেখানে বাড়ির আলো বড়ো ছায়া তৈরি করেছে, সেখান থেকে খুব কথাবার্তা শুনতে পাবেন। আপনি যদি সাদা হন, সেই কথাবার্তা বেশ চিত্তাকর্ষক লাগবে। তবে একইসঙ্গে তা একঘেয়ে, দুঃখজনক ভয়ংকর লাগতে পারে। এই প্রেক্ষিতে, আপনি যদি অন্য কিছু না হতে পারেন, মফস্সলের কবি ভিঁলো হওয়া খুব একটা খারাপ হবে না, তবে সেটা হবে ট্র্যাজিক। পেনি হুইসিল একটা চমৎকার সংগীতের অভিনব জিনিস কিন্তু সেটা একজন মানুষের পক্ষে সবসময় বাজানোর প্রয়োজন হয় না।
কতিপয় দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী তাদের এই অচ্ছুৎ মফস্সলে বেশ কিছুটা হালকা গায়ের রং নিয়ে জন্মান। তাদের এমন রঙের জন্য তারা কিছু কিছু সুবিধা ভোগ করে থাকে—ভালো কাজ, ভালো বাসস্থান, কিছুটা স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা—এগুলো তাদের সাদাদের অনেকটা কাছাকাছি এনে দেয় অর্থাৎ তাদের জীবনযাপনে অনেক কম বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। আবার এই অচ্ছুৎ মফস্সলেই কিছু আফ্রিকাবাসী প্রায়-সাদা গায়ের রং নিয়ে জন্মান, তাদের সাদা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। সাদা চামড়াকে এখানে যেন শিশুর মুখে সোনার চামচ হিসাবে গণ্য করা হয়; অন্য দেশে এই প্রায়-সাদা মানুষটি নিজেকে পুরো সাদা বলে চালানোর লোভ সামলাতে পারে না সামাজিক কারণে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায় একটা বিষণ্ণ মুখ ও খাড়া চুল মূল ব্যবস্থার সুযোগ নিতে পারে—একটা ভালো স্কুল, চালু বিধিমতে প্রত্যাখ্যানের বদলে গ্রহণ।
বহু অশ্বেতকায় পিতামাতার উচ্চাশা থাকে যে তাদের সন্তান যেন যথেষ্ট হালকা রং নিয়ে জন্মায়, তাহলেই সে রঙের নিষেধের গণ্ডি ডিঙিয়ে, হলেও বিপজ্জনক মিথ্যে, সাদা বলে সুযোগ নিতে পারে; অবশ্য সত্যিটা ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়টা থেকে যায়। তবে সেদিন রাতে আমি অন্য এক ধরনের ভয়ের কথা জানতে পেরেছি অর্থাৎ সাদা-সাজার পুরোনো খেলার নতুন বয়ান : একজন চেনা ভারতীয় আমার কাছে স্বীকার করেছেন যে তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন কারণ তার তেরো বছরের ছেলের মুখ ও গায়ের রং সাদা বলে চালানো সহজ—“ছেলেটি সাদাদের সিনেমায় চুপিচুপি ঢুকে পড়ে, মাত্র একবার, সম্ভবত মজা হবে ভেবে। এরপর আমি ও আমার স্ত্রী বুঝতে পারছি, সে এবার সাদা সাজতে থাকবে। এমন ছেলেরা যদি একবার জানতে পারে সাদা হওয়ার সুযোগসুবিধা, আপনি তাদের আটকাবেন কীভাবে! এটা তো মিথ্যে আর তারা তাদের নিজেদের পরিবার ও পরিবারের দুর্দশা জানতেই চাইবে না। এ জন্য আমি দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে চলে যেতে চাই, কারণ অন্য জায়গায় আমার ছেলেরা যা নয়, তা হতে চাইবে না।”
আমি রঙের নিষেধের গণ্ডির ভুল নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে দু-পক্ষই ভুল। মনে করবেন না যে আমরা যারা সুযোগপ্রাপ্ত সাদা, আমাদের লোকজন সমাজে নিরপেক্ষ আছে। আমরা কষ্ট পাচ্ছি না বটে, তবে আমরা বেশ অমার্জিত আছি। এ দেশে জীবনযাপন করতে হলে বর্ণবৈষম্য সামান্য হলেও মেনে নিতে হয়। সাড়া দেওয়া-নেওয়ার সীমান মানতে হয়। মানুষের হৃদয় নিঃসাড় হয়ে পড়ে। আমাদের বাচ্চারা ভালো খাওয়া, ভালো জামাকাপড় পরে বেড়ে ওঠাকে স্বাভাবিক ভাবে, অথচ কালোদের বাচ্চারা হাড় জিরজিরে ও ছেঁড়া জামাকাপড়ই পরতে পায়। সাদা ছেলেদের মনে হয় না যে কালো ছেলেদের দান ছাড়া অন্য কিছুতে অধিকার আছে; যদি আপনার সদিচ্ছা থাকে আপনার উচিত হবে সাদা ছেলেদের বোঝানো যে এমন ব্যবস্থা মানুষই চালু করেছে—সাদারা সব পাবে, কালোরা কিছুই পাবে না। এই নিয়ম কিন্তু সকালে সূর্য ওঠার মতো চিরন্তন নিয়ম নয়। এসব সত্ত্বেও বর্ণবৈষম্যের প্রতিরোধ পুরোপুরি সম্ভব হয় না, প্রাপ্ত সুযোগসুবিধার আবেগ এমনই। সমস্ত কিছুর ভালোটা আমাদের—সাদাদের প্রাপ্য—আর তাই গোপনে কিছুটা হলেও আমরা অনুভব না করে পারি না যে আমরা ওদের থেকে উৎকৃষ্ট।
দক্ষিণ আফ্রিকার শত সহস্র সাদারা তাদের এই বিশেষ সুযোগসুবিধা ধরে রাখার জন্য মরিয়া। তারা বিশ্বাস করে এমন একতরফা সুবিধাভোগ করার জন্য মৃত্যু পর্যন্ত স্বীকার করতে রাজি, অর্থাৎ তারা সামান্যতম সুযোগ ছাড়তে নারাজ; তবু আমি বিশ্বাস করি তারা সুযোগ কিছুটা ছাড়তে পারে। সাদারা তেমন জীবন কল্পনা করতেই পারে না যা তাদের নয়, কিংবা কালোদেরও নয় বা অন্য আরেকটি জীবন। তারা কীভাবে ভাববে স্বাধীনতার কথা যখন তারা বছরের পর বছর নিজেদের জন্যে সেটি কুক্ষিগত করে রেখেছে!
সাদা বা কালো কেউ আমরা কথা দিতে পারি না যে কালোদের কর্তৃত্ব সাদাদের কর্তৃত্বের বিকল্প হতে পারে না। আর এতদিন সাদারা যে অত্যাচার করেছে তার প্রত্যুত্তরে কালোদের প্রতিশোধ দীর্ঘ হতেই পারে। কারণ বর্ণবৈষম্যের এমনই প্রতিক্রিয়া—বহু কালো বা সাদা মানুষ ভাবতে পারে না যে জীবনটা কালো বা সাদা কারোর মতোই হবে না। তবু বেশ কিছু দক্ষিণ আফ্রিকার সাদা ওই সুবিধা ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক—ধরে রাখতে চায় না—তারা হয় দীর্ঘদিন এমন সুবিধা ভোগ করে ভীত বা বীতশ্রদ্ধ আর এভাবে জীবনযাপনে লজ্জিত। এদের বর্ণান্ধ বলা যেতে পারে, হয়তো নতুন এই দলে একটা অস্বাভাবিক মরিয়া স্বভাব চাপ তৈরি করেছে। তারা আরেক ধরনের নতুন জীবন চান দক্ষিণ আফ্রিকায়। তারা চান সমস্ত রঙের মানুষ একটাই দরজা ব্যবহার করুক, একইরকম শিক্ষা পাক, একে অপরকে সমান ভাবে সম্মান জানাক। সাদা বা কালোর জন্যে সরকার কি গ্যারান্টি দিচ্ছে তারা সে সব নিয়ে চিন্তিত নয়। এদের মধ্যে আবার অনেকেই এক বা একাধিক রাজনৈতিক কারণে জেলে যেতেও প্রস্তত—এই উদ্যমে তারা বিশ্বাস করে যে নতুন জীবনে তারা স্থিত হতে পারবেন। বাকিরা বর্ণবৈষম্য মেনে তার মধ্যেই যতটা সম্ভব সুন্দরভাবে জীবন অতিবাহিত করতে চান।
আমি জানি, দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষরা বর্ণবৈষম্য সাদাদের কী ও কেমন বিশেষ সুবিধা দিচ্ছে, তাতে আর গুরুত্ব দেয় না এবং এ জন্য কেউ কালোদের দোষারোপ করে না। কালোদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ হলো : আপনার বিচারবোধ নিষ্ঠুরভাবে লঙ্ঘিত, বিবেক সমস্যাদীর্ণ আর বর্ণের জন্য নিষেধের ফলে বন্ধুত্ব বাধাপ্রাপ্ত। এ সমস্ত কিছু অনুচ্চার হলে সাদা ও কালো বন্ধুর কাছে গভীরভাবে রয়ে গেছে। আমার নিজের কয়েকজন পছন্দসই কালো বন্ধু আছেন যাদের বন্ধুত্ব শুধুমাত্র বর্ণের জন্য আমি অন্তত ছাড়তে রাজি নই—বর্ণের তত্ত্ব আমার কাছে অর্থহীন, অবান্তর। অন্যান্য অনেকের মতোই বর্ণবৈষম্যের প্রতি আমার বিরোধিতা তৈরি হয়েছে আমার বিচারবোধ, ব্যক্তি স্বার্থ, তীব্র অপছন্দের দ্বারা, কারণ আমার বন্ধুত্ব বা মানুষিক আদানপ্রদান কারও নির্দেশে পরিচালিত হয় না।
এই জন্যে সাধারণ বন্ধুত্বের খাতিরে আমি মাঝেমধ্যে চাই আমার কালো বন্ধুরাও সামান্য ঝুঁকি নিক, যা মোটেই তাদের পক্ষে উচিত নয়; কেননা তারা জীবনের মৌলিক কয়েকটি বিষয়ে অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যেই আছে।
গত বছর একটা দিনের কথা মনে পড়ছে। যখন আমার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আফ্রিকার অশ্বেতকায় বন্ধুদের বিদায় জানাবার জন্য বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম, আমি নিজের জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম, আর বন্ধু এলিসও তার খাবার নিয়েছিল, কারণ আমরা জানতাম আমরা একসঙ্গে বিমানবন্দরের রেস্তোরাঁয় খেতে পারব না, অনুমতি মিলবে না। তবু তখনও বুঝতে পারিনি যে, বিমানবন্দরের ভেতরে বাইরে কোনো একটা কোণে আমরা খেতে বসতে পারব না। আমি নিয়মাবিধি না মেনে কোথাও একটা জায়গায় বসে পড়েছি যদিও সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আলাদা বসার নির্দেশ এসে গিয়েছিল। আমার পক্ষে ব্যাপারটা হয়তো সহজ, আমি সাদা, এমন রোজের অপমান সহ্য করতে হয় না। কিন্তু কালো এলিসকে উত্তর খুঁজতে হয় যখন তার বাচ্চারা তাকে প্রশ্ন করে, চিড়িয়াখানায় তারা কেন হাতি চড়তে পারে না, আবার এলিস সব সময় বাচ্চাদের বকাঝকা করতেও পারে না।
অনেকরকম আইনি নিষেধের ঘেরাটোপে থেকেও কিন্তু কালো ও সাদারা একে অপরকে জানতে পারে। আমরা শহরের ভিতর কখনও সাক্ষাৎ করতে পারি না কারণ সেখানে দুজন বসে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। সাদাদের বাড়িতে কালো অতিথিকে গ্রহণ করার আইনি ব্যবস্থা অস্বচ্ছ; যদিও আমাদের বাড়িতে নিশ্চয়ই তেমন অতিথিকে গ্রহণ করি তবে ঝুঁকি থাকে কেননা কোনো প্রতিবেশী পুলিশে নালিশ করে দিতে পারেন, আর পুলিশ এই নালিশের প্রতি ভীষণ সহানুভূতিশীল। যখন আপনি আফ্রিকার কোনো কালো বন্ধু বা অতিথিকে পানীয় দেবেন তখনই আপনি নিয়ম ভাঙবেন; বিয়ারের গ্লাস আপনার হাত থেকে অতিথির হাতে যাওয়ার অর্থই হলো আপনারা দুজনেই বিশেষ রকম আইন ভাঙার জন্য পুলিশ কোর্টের আওতায় চলে আসবেন।
সরকারিভাবে সাদারা দক্ষিণ আফ্রিকার ছোটো শহর তথা মফস্সলে ছাড়পত্র ছাড়া যেতে পারে না। আর আমরা যখন কালোদের মফস্সলে বন্ধুদের কাছে যাই পুলিশ যাতে আটকাতে না পারে সেই সুযোগটা নিই। পুলিশ সাধারণত দুষ্কৃতী বা চোরাই মদ ধরার জন্য মোতায়েন থাকত, তবে তারা মাঝে মাঝে আবার বর্ণবৈষম্যের পক্ষে কাজ করত।
গত বছরের শেষ দিকে আমি একটা ছোটো সাদা দলের সদস্য হয়ে নিমন্ত্রিত ছিলাম একজন আফ্রিকান ডাক্তার ছাত্রের বিবাহ অনুষ্ঠানে। সেখানে অভ্যর্থনার জন্য টেবিল ছেড়ে উঠতে হয়েছিল; সেখানেই স্বর্ণখনি কোম্পানির জনৈক সাদা আধিকারিক, যে কোম্পানিতে কন্যার বাবা কর্মরত, এবং বর্তমান অনুষ্ঠান বাড়িটার মালিক, সেই আধিকারিক আমাদের জানান যে বিবাহের অনুষ্ঠানে আমাদের নিমন্ত্রণ যথাযোগ্য নয়, সুতরাং আমরা আফ্রিকার অশ্বেতকায় কোয়ার্টারে উপস্থিত থাকতে পারি না।
কালো সাদাদের মধ্যে যে-কোনো ধরনের বন্ধুত্ব এইসব নানা ঝামেলায় জটিল। সুতরাং দু-পক্ষে সম্পর্ক রাখা বেশ কষ্টকর, তা সাধারণ বা গোপন যেমনই হোক। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক যতই উষ্ণ হোক, গভীর হোক, বোঝাপড়া আরামদায়ক হোক, তাতে কিছু আসে যায় না—সেখানে প্রায়শ এমন মুহূর্ত তৈরি হয় যে একদিকে সাদাদের সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য ক্রোধ; অন্যদিকে সুবিধাভোগী হওয়ার জন্য এক ধরনের অপরাধমনস্কতা জাগে নিশ্চিত।
সর্বোপরি আরেক জীবনের টুকরো :
আপনার কানে গোলা ভরুন এবং পুরোনো হুঁশিয়ারি শুনুন :
আপনি কি কালোদের দ্বারা চাপা পড়তে চান!
জনৈক কালো আফ্রিকাবাসীর স্কুটারে সামান্য ধাক্কা খাই যখন তিনি স্কুটারটি পার্ক করছিলেন। আর দুজনের পক্ষে ক্ষমা চাওয়া বা দোষারোপ করার তিলমাত্র সুযোগ না দিয়ে তখুনি একজন সাদা মানুষ আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে বলতে চান, আমি কোনো অন্যায় করিনি এবং ওদিকে সঙ্গে সঙ্গে তিনজন কালো মানুষ স্কুটার আরোহীর পক্ষে এসে যায়।
সর্বোপরি আরেক জীবনের টুকরো!
আপনার কানে গোলা ভরুন এবং পুরোনো হুঁশিয়ারি শুনুন :
আমার বন্ধু একজন দায়িত্বশীল সম্মানিত কালো বৃদ্ধ রাজনীতিককে কয়েকজন সাদা যুবক মারধোর করে যখন তিনি সাদা মানুষদের মিটিংয়ে বক্তৃতা করছিলেন।
পৃথক হয়ে জীবনযাপন করে কালো ও সাদা দু-পক্ষই নিজেদের নৈতিকভাবে ধ্বংস করে চলেছে। তবু মনে হয়, সাদা ও কালো একসঙ্গে থেকে সাদা ও কালোর আধিপত্য অগ্রাহ্য করে এবং আরও যেসব নিয়মাবিধি আমাদের দু-পক্ষকে একে অপরের কাছে লুকিয়ে রেখেছে, তা অতিক্রম করে তার মধ্যেই আমরা প্রকৃত মানুষ হিসাবে নিজেদের আবিষ্কার করে নিতে পারি নিশ্চয়।