সদ্য মরে যাওয়া একটা লোকের শোক থাকে। সমালোচনা থাকে না। তাই,
“— লোকটার নাড় ছিল অনেক…।”
“— শাল্লা, বউকে পিটত, মদ গিলত…।”
এমন কথা কেউ বলেনি। নীরু শাসমল, নিরঞ্জন শাসমল মরে গেছে তিনদিন আগের এক ভোরে। প্রত্যেক মৃত ব্যক্তি যেমন অধোমুখো মানুষ ডেকে আনে, নীরুও পেরেছিল। পারার যে অনেক কারণ ছিল এমনটা নয়, তবে নীরুকে তো চিতায় উঠতে হবে! আগুনে পুড়তে হবে! নীরুর বউয়ের শাঁখাজোড়া ঠুকে ঠুকে ভেঙে ফেলতে হবে, আর সেই ফাঁকে নীরুর বউ… আহা! সতী সতী!

এসেছিল। পাড়া পাড়া থেকে লোক এসেছিল। এমনই তো রেওয়াজ! বিয়ে বাড়িতে না যাও, অন্নপ্রাশনের ভোজে না গেলেও পারো, কিন্তু মানুষ মরে গেলে যাওয়া চাইই চাই। আর কোনো সত্যি না মানুক, এই সত্যিটা সকলে মানে—মরে যাওয়া থেকে শুরু করে ছাই হওয়া পর্যন্ত আসল সত্যিটা। যদি নিজের বেলায় লোক না জোটে! অন্তত চারটা কাঁধ! অন্তত বাঁশ দিয়ে আগুন খোঁচার দু-চারজন! নিরঞ্জনের বেলায়,
“—লোকটা যা ছিল ছিল, কিন্তু কাজটা করে উদ্ধার ত করতে হবে… অন্তত সতী সাধ্বী বউটার দিকে চেয়ে।”

আজ চতুর্থা। যারা কাঁধ দিয়েছিল, আজ তাদের নিমন্ত্রণ। অনিমেষ যাবে। সেদিন আগাগোড়া ছিল সে। সে ছিল বলেই নীরুর নাভিটা শেষ পর্যন্ত অতি ক্ষুদ্র একটা কয়লার সঙ্গে মেশানোর মতো অবস্থায় নিয়ে যাওয়া গিয়েছিল। না হলে দহনের তাতে লোকগুলোই এক এক করে নাভির মতো কুঁচকে গিয়ে সরিয়ে নিচ্ছিল নিজেদের। বাঁশ দিয়ে খুঁচে খুঁচে শেষ অবধি ঠায় দাঁড়িয়েছিল অনিমেষ। তারপর সব শেষে জ্বলন্ত কাঠে কলসি কলসি জল ঢেলে-ঢালিয়ে কাঁচা ছোলা আর গুড় খেয়ে ঘরে ফিরেছিল সে।

চতুর্থার সন্ধ্যায় মিতাকে একটু উঠে দাঁড়াতে হয়েছে। সবমিলিয়ে নাই নাই করে অন্তত জনা তিরিশেক লোক। একা মিতাকেই পরিবারের তরফ থেকে আপ্যায়ন করতে হবে। একটা বছর চারেকের মেয়ে ছাড়া তো আর কোনো প্রাণ ছেড়ে যায়নি নিরঞ্জন!

“বোধয় না…!”

এই কথা তলে তলে সবাইকে ভাবায়। মিতাকেও। যারা শোকের খাতিরে কিছু বলেনি, তারা এখন বলে কিংবা চোখে চোখে ভাবে। নিরঞ্জন যদি নাড়ের কুলে কাউকে রেখেও গিয়ে থাকে, তাতেও নীরুর শ্রাদ্ধ শান্তির কাজে তারা এগিয়ে আসবে না। হয়তো এই মুখ ঝোলানো সন্ধ্যার গায়ে হেলান দিয়ে কাছে পিঠে কোথাও নীরুর কোনো ছেলে কিংবা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে! নিজেদের অজান্তে দাঁতে ঝাঁটাখাঁচি খুঁচে খুঁচে খাবার বের করছে!

নীরুর গ্রামের লোক অনিমেষ। হেঁটে যাওয়া পথে কয়েকটা জমির বন্দ পেরোলেই। মরে যাওয়ার খবর পেয়ে আর পাঁচজনের মতো অনিমেষও এসেছিল। তখনও অনিমেষ তার নিজের মাথায় খচ খচ করে কোনো আটকে যাওয়া কথা খুঁজে পায়নি। পেয়েছিল ঘরে গিয়ে। প্রায় দোসন্ধ্যার খ্যাঁচড়া সময়ে। যে সময়ে কোনো ভাব নরম শীতল বাতাসে দম পায়। চিতায় তোলার পর থেকেই দক্ষিণ পাড়ার বাদল খুঁচানি ডাঙটা দিয়ে নীরুর সারা গায়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রসিকতা করছিল,
“শালা, কতখানি রস থাকলে নাগর হওয়া যায় বল,
—কাউকে বাদ দেয়নি!”

চিতার চারপাশে চাপা হাসির রোল উঠল। অনিমেষ ছাড়া বাকি সবাই কমবেশি মদ ঢেলেছে। এমন হয়ই। সব মৃত্যুতে তো শোক থাকে না! অন্তত নিরঞ্জনের মৃত্যুতে কেউ তলিয়ে যায়নি।

— গেছে ভালো হইছে…।
— বউটা যা-হোক হাঁফ ছেড়ে বাঁচল…।

বয়স হয়নি যাওয়ার, তবুও কেমন করে যেন! গ্রাম্য শব্দ আর শব্দবন্ধে নিরঞ্জনের বহুগামী সম্পর্কের কচকচালির ঢল ওঠে। রাত বিরেতে বন-বাদাড়, কারো ঘরের কাঁদাল। বিচারও খাটছে কতবার, তবু নেশা কাটেনি। সেই উৎপাতেই যে ভেতরে ভেতরে কোনো গোপন রোগ সে পুষে বেড়াচ্ছিল, সবাই নিশ্চিত।

চিতার আগুনের লাগাতার আঁচ থেকে রেহাই পেয়ে নিরঞ্জন যখন মিলিয়ে গেল, অনিমেষ ঘরে ফিরে এল। শীতল হতে হতে যখন প্রাণের সঞ্চার হলো গ্রহে, মাথা ঘুলিয়ে উঠল তার। নীরুর যাওয়া আসা ছিল অনিমেষের ঘরে। ক’দিন আগেই তো এসেছিল! লম্বা ক্ষীণ শরীরের লোকটা! মধ্য চল্লিশের বয়স। পুরুষ বলতে এখনও সবাই যা বোঝে, তেমনই ছিল সে। এসে অনেকক্ষণ বসেছিল অনিমেষের সঙ্গে। দক্ষিণের ফাঁকা মাঠ থেকে বাতাসের একটা দল হুড়মুড়িয়ে পড়তেই আচমকা কথাটা বলে ফেলল নীরু,
— জাগাটা বিচে দিবো জানু। লিবি?

যে জায়গার জন্য লোকে হাপিত্যেশ করে, সে-ই রোড সাইডের জায়গাটা হাতছাড়া করে দেবে নিরঞ্জন! এমনিই বলেছে হয়তো! বলতে পারে। তাছাড়া লোকটা বিশ্বাসের নয়। মাগ লিয়ে ঘুরে বেড়ায়। হয়তো আজ টান পড়ছে বলে…

দুজন সমবয়সি অথচ কোনো টান নেই। অনিমেষ যেন শুনেও শোনে না। তাছাড়া এত সামর্থ্যও তো নেই তার।

— আমি ভাবছি, তোকেই দুবো। একদম কম দামে করে দিবো।

এই কথার গায়ে হাসা যায় শুধু। যত কম করে হলেও অন্তত ষাট-সত্তর হাজার টাকা ডেসিমাল তো বটেই। কোথায় পাবে অনিমেষ। সকাল সন্ধ্যা ছেলে পড়িয়ে যার সংসার চলে।

তারপরেও নিরঞ্জন ওঠেনি। বিকেল থেকে সন্ধে অবধি বসেই রইল। অন্য কোনো সম্পন্ন ক্রেতার কাছেও গেল না। অনিমেষ অবাক হয়নি। ভেতরে ভেতরে একটু খুশিই হয়েছে যেন। অনিমেষ জানে, পৃথিবীতে ভালোবাসা কিংবা স্নেহ বিলিয়ে দেওয়ার লোক যেমনই হোক, তাকে এড়িয়ে চলা চলে না। বউ রত্নার কাছে রাত-বিছানার গল্পে নিরঞ্জনের এই কথা বলে বলে সে গলে গেছে। দুঃখ পেয়েছে নীরুর সংসারের অদৃশ্য প্রয়োজনের কথা ভেবে।

— একটু ভালো হতে পারত লোকটা!
কিংবা,
— এত ঠকেও কী শিক্ষা হয়নি মানুষের!

এখনও সবকিছু থরে থরে থিতিয়ে আছে অনিমেষের মাথায়। ভুলে গেলেই ভালো হত হয়তো। আজ দাহ করবার সময় যদি ভরত নেশার ঘোরে কথাটা না তুলত…মনে পড়তেই সে-ই কথাটা মাথার এপাশ ওপাশ কর্কশ শব্দে চিরে গেল অনিমেষের।

— নতুন পুকুরের কাছের পাঁচ কাঠা জমিটাউ ত গ্যাছে রাঁড়ের খপ্পরে…
বলে, ভরত একটা রসালো কাঠের টুকরো ছুঁড়ে দিয়েছিল চিতার বেপরোয়া আগুনে।

— এই জমিটাউ কী তাহলে!
দুয়ারে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে সে-ই যে এসে বসেছিল অনিমেষ, সন্ধ্যা থিতিয়ে পড়ল ক্রমে। ঘুলিয়ে থাকা মাথা এখন জট পাকিয়ে ঘোঁত খাচ্ছে না। কেবল একটাই ভাবনা এখন তিরের মতো বিঁধে গেছে। “নিরঞ্জন মোটেই ভালো লোক ছিলনি…খচ্চর ছিল—চরিত্রে, চালে। উ আবার কবে থিকে লোকের ভালো করতে শিখল!”

তেতে উঠছে অনিমেষের সারা শরীর। দাহ করতে গিয়ে কি ভুল করল সে? না গেলে ভালো হত মনে করতে করতে তার কপালের দু-পাশের রগ টনটনিয়ে ওঠে। পা চলতে চায় না ভাবনার ভারে। তবুও কীসের টানে চেয়ার ছেড়ে পায়ে পায়ে রান্নাঘরে যায়। রত্না রাতের রান্না বসিয়েছে। গ্যাসের নীলাভ আলো চোখে পড়তেই অনিমেষের গা শিউরে ওঠে।

রত্নার পাশে দাঁড়িয়ে সাবধানে ঘোলাটে চোখগুলো দিয়ে কী যেন দেখে, দেখতে চায় অনিমেষ। অন্তত একটা কিছু কুঁড় পেলে যেন অঙ্কের সূত্রটাকে সে মেলাতে পারবে। তারপর যত কষ্টই হোক, হবে নিশ্চয়ই, তবু সূত্রে ফেলে কোনো কিছুকে মিলিয়ে দিতে পারার পঙ্কিল আনন্দ তো থাকবে! রত্নার ছলছলে চোখ কিংবা যতখানি মনখারাপ গোপন রাখা যায়—সেটুকুও আঁচ করতে পারল না অনিমেষ। পা গুলো ভারী হয়ে এল তার।

নিরঞ্জন আর অনিমেষ বন্ধু যে ছিল না—তা তো নয়! কথা হত রাস্তায় ঘাটে। মঙ্গল শনিবারের হাটে। লোকের কাছে কথা হত নিরঞ্জনকে নিয়ে। কিছুদিন আগের এক মাঝ সকালে ভাগে চাষ নিয়ে কথা হচ্ছিল। লম্বা নিরঞ্জন যেন আগে ভাগে সবকিছু দেখতে পাচ্ছে, বলে উঠল— “আবার যদি সেরকম বৃষ্টি হয়! শালা এক রাতের জলেই মাঠ সাদা। তখন ভাগ দিবো কী আর খোরাকির তরে কী থাকবে?”

অনিমেষ কিছু বলে না। স্থির হয়ে নিরঞ্জনের কথা শোনে। নিরঞ্জন পেরিয়ে গেলে আরো দু- চারজনকে ঈশারা করে অনিমেষ হাসে একটু। দু-চারজনও হাসে। তাদের সবার মধ্যে এই একই সময়ে কেবল এক ধরনের কথাই জন্ম নিতে পারে—”যেন কত সাবধানী! কুনো ঝুঁকি নেবেন না বাবু, এদিকে রাত দিন কী নাই কী করে যায়ঠে!”

সবাই জানে। সব্বাই জানে। নীরু কেমন—নীরু এমন! টাগরায় কেউ যেন সে-ই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে একটাই বিশেষণ স্থির আটকে রেখেছে নিরঞ্জনের জন্য—”বদ। চরিত্রহীন। এ লোক ভালো হতে পারে না। কারো ভালো করতে পারে না।”

তিনদিন তিনরাত গুনে গুনে প্রতিটা মুহূর্ত কাটিয়েছে অনিমেষ। চতুর্থ দিনের দিন নিশ্চিত কোনো একটা সুরাহা মিলবে ভেবে। এই তিন দিনের আলো যেন কোনোভাবে বৃথা না যায়—এমন ভেবে অপলক তাকিয়ে থেকেছে রত্নার দিকে। শুধুমাত্র স্নান সেরে আসার পরের কয়েকটা মুহূর্ত ছাড়া। কারণ এখনও ভেজা মানুষের অনুভূতি পড়তে শেখেনি অনিমেষ। এমনকি সন্ধ্যা বা রাতের যে সময়গুলোতে আলো প্রায় থাকত না, কানগুলোকে অসম্ভব রকমের সজাগ করে রাখত সে। হয়তো অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আত্মার উদ্দেশে রত্না কিছু নিবেদন করবে! পায়নি! তেমন কিছুই শোনেনি অনিমেষ।

শুধু একদিন উত্তর-পশ্চিম কোণের দিকে তাকিয়ে নিঃসন্তান গলবস্ত্র রত্না একটা প্রণাম ঠুকেছিল। যেদিকটায় এখনও গরম হয়ে আছে নীরুর চিতা। অনিমেষ শুধু দেখলই না—একটা দৃশ্য লুফে নিল যেন।

আজ চতুর্থা। কারো কাজে অনিমেষ এতক্ষণ থাকে না। আছে শুধু নিজের গরজেই। যে লোকটা আর নেই, অন্তত তার না থাকার সূত্র ধরে কিছুই কি কুঁড় খুঁজে পাবে না সে। কিংবা তাকে দেখে মিতা যদি সত্যিই অস্বাভাবিক কিছু করে, তাহলেও অন্তত নিজের অনুমানকে শক্ত মাটির উপর দাঁড় করাতে পারবে অনিমেষ।

এমন কী করবে মিতা!
কী দেখে খুশি হতে চায় অনিমেষ!

মিতা এখন তার দিকে অপলক চোখে স্থির কিছু সময় তাকিয়েই থাকুক। সব ব্যস্ততা এড়িয়ে ভাবুক শুধু নিধনা অনিমেষের কথা। বউকে নিজের পাল্লায় রাখতে না পারা অনিমেষের কথা। সে মনে মনে কল্পনা করে নিক—রত্নার শরীরী বানের ছবি। দোষ দিক অনিমেষকেই। হয়তো দেবেও না দোষ। হয়তো গা-সওয়া হয়ে গেছে মিতার। এতদিন ঘর করতে-সইতে…হোক! মিতা সয়ে নিক। মিতার সয়ে নেওয়া সমীচীন। মিতা সব জানে যে! সে জানে, নিরঞ্জনের ধরা আছে—অমুকের বউ কিংবা তশুকের বিধবা দিদি। কিন্তু অনিমেষ যে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। খুব বেশি লোকের ভিড় নেই। খুব ব্যস্ত নেই মিতা। বারবার মুখা-চোখি হয়েছে অনিমেষের সঙ্গে। কিন্তু কোনো বিকার নেই তার। অন্তত একটু সন্দেহজনক কিছু দেখতে পেলে বর্তে যেতে পারত অনিমেষ।

আর কতদিন সে বয়ে নিয়ে বেড়াবে—এই মরে যাওয়া নিরঞ্জনকে! মিতাও তো আর আটদিন পর সব দায় ঝেড়ে ফেলবে। কিন্তু অনিমেষ! আর কিছু ভাবতে পারে না সে। ভাদ্রের কুয়াশার মতো তবু চিটে আছে ভাবনাটা।
“—ভালো ছিলনি লোকটা। ভালো হতেই পারেনি।”

মিতার ঘরের সামনে এক চাকলা খামার। খামারের শেষে রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে একটু পূর্বে হেঁটে গেলেই পুকুরটা। সেই পুকুর পাড়ের ঈশান কোণ থেকে নরকে গেল নিরঞ্জন শাসমল। চার দিনের দিন এই অন্ধকারে জায়গাটা কেবল ঠাহর করে নেওয়া যায় মাত্র। অন্ধকারে এই ঠাহর করার সময় অনিমেষের চোখের সামনে কেবল একটা দৃশ্যই হাত নাড়া দেয়—রত্নার গড় করার দৃশ্যটা। মুহূর্তের মধ্যে আরো অনেককিছু ভেবে নেয় সে। যে ভাবনা তার একান্ত নিজস্ব। যা ভাবলে সে নিজে সুখী হয় কেবল।




প্রচ্ছদচিত্র সৌজন্য: www.pinterest.com