মা’র টাইম ছিল সক্কালবেলা। বাবা, কাকা অফিস থেকে ফিরে সন্ধেবেলা। ঠাকুমা, পিসির দুপুরবেলা। আমাদের কোনও টাইম ছিল না। না থাকলেও ক্ষতি খুব একটা ছিল না কারণ তিন বেলা কানের কাছে বাজছে। তবে মা’র টাইমটা ছিল সবচেয়ে ভালো। গানের কিছুই বুঝতাম না, আজও বুঝি না, কিন্তু ঘুমটানা চোখে কানে বড় মধুর লাগত সে-ই গান। গানের কথা, সুর, চোখের ঘুম, সব মিলিয়ে একটা আবেশ, ঠিক বোঝাতে পারব না। বাড়ির বড়রা যেভাবে রেডিও শুনতেন আমাদের সেভাবে শোনার অধিকার ছিল না। ঠাকুমা, পিসি দুপুরে নাটক শুনতেন। স্কুলে থাকতাম বলে সেটা নিয়ে খুব একটা মন খারাপ ছিল না। কিন্তু রেডিও খারাপ হয়ে গেছে, অর্থাৎ আজ কেউ গান বা নাটক শুনতে পাবে না; এইটে কানে শুনে, স্কুলে যেতে বড় শান্তি পেতুম। বাবা, দুই কাকা খবর শুনতেন গোঁজ হয়ে বসে। তাঁরা আবার গান শুনতেন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে, গুনগুন করে আবার সুরও মেলাতেন! আমি, দাদা, দিদি ছিলাম দূরের শ্রোতা। বড়দের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুনছি—এটা কোনওমতেই তাঁদের বুঝতে দেওয়া চলবে না। দাদা উঁচু ক্লাসে পড়ত। তার ভাবগতিক ছিল আমাদের দুজনার থেকে আলাদা। মাঝে মাঝে কী এক আশ্চর্য ক্ষমতাবলে সে দেখতাম রেডিওর কাঁটা ঘোরাত, কেউ কিছু বলত না। কারণ জানতে চাইনি কখনও, জানলে বিপদ বাড়তে পারে এই ভয়ে। তবে দাদা কাঁটা ঘোরানোর বরাত পেলে আমরা খুশিই হতাম। সে এমনসব রেডিও স্টেশন চালাত, যেখানে নানারকম হিন্দি গান হতো। একটা ছিল শিলং। পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে, বিয়ে বাড়িতে যেসব গান কালেভদ্রে শুনতে পেতাম, সেইসব গান হতো শিলং স্টেশনে। এসব কায়দা বাবা-কাকারা যাতে টের না পায় সেটা অবশ্যই আমরা খেয়াল রাখতাম। দুজনের কথা খুব মনে পড়ে। ইভা নাগ আর নীলিমা সান্যাল। ওই দুজন দিল্লি থেকে খবর রিলে করে শোনাত। বাবা, রাত দশটাই হবে বোধহয়, রোজ চালাতেন সে-ই খবর। রেডিওর শব্দটা তখন অন্যরকম শোনাত। খবরটা দিল্লি থেকে আসতো বলে কিনা জানি না, সে-ই গলার স্বর কিন্তু আজও কানে বাজে।

যাই হোক, আসল কথা যেটা বলব বলে শুরু করেছি: রেডিও তখন সব বাড়িতেই একটি অত্যাবশ্যক পণ্য। প্রায় সব বাড়িতেই বস্তুটি কম বেশি আছে। আর সেগুলো বেশ বড় বড় সাইজের, গমগমে আওয়াজ। আমাদের বাড়িতে যেটা ছিল সেটাও প্রকাণ্ড। শুনেছি তার আগেও দুটি রেডিও ছিল। প্রথমটা কাকা মন দিয়ে গান না শুনতে পেয়ে, সেটি আছাড় মেরে ভাঙে। আর দ্বিতীয়টা নাকি আলমারির মাথা থেকে আচমকা পড়ে গিয়ে ভাঙে। আমি যেটা দেখেছি তার সামনে একটা সবুজ আলো জ্বলত। সেটাকে বলত ম্যাজিক আই। স্টেশন ঠিকঠাক ধরতে পারলে আলোর মাঝখানের কালো দাগটা মিলিয়ে যেত। যত দাগ তত চুঁই-চাঁই, কড়মড়, শব্দ। ঠাকুমা বলত,—‘ঠিক করে চালা, ও গানের সাথে সাথে চাল কলাই ভাজছে যে!’ ঠিকঠাক স্টেশন ধরা হয়েছে কিনা সেটা বাবার ঘাড় নেড়ে আর চোখ বুজিয়ে মাথা দোলানো দেখেই বুঝে যেতাম, আলো মিলেছে বটে। মাঝের কালো দাগ নেই আর।

ট্যাঁপা কাকার কথা বলবো বলে শুরু করে এ কথা সে-কথা বকে চলেছি। বাড়িতে দুটো লোক তাকে চিনত। আমি আর ঠাকুমা। তার সঙ্গে আমার পরিচয় এই রেডিওর হাত ধরেই। ঠাকুমার কথা বলছি না, কারণ ঠাকুমা চেনে-না এমন লোক কোথায়? সবাই তাকে চেনে! ট্যাঁপা কাকা ছিল রেডিওর কারিগর। রেডিও কিনতে গেলে হ্যাপা অনেক কিন্তু সারাবার লোকের অভাব ছিল না। সারাবার জন্য দোকান-টোকান থাকলেও ঘরে ঘরে রেডিও সারাবার লোক পাওয়া যেত। অনেকটা কুটিরশিল্পের মতো। দোকানে কেউ খুব একটা যেত না। তার আসল কারণ হলো অতখানি গতরটা টেনে নিয়ে দোকানে যায় কে? অতএব বাড়িতেই লোক ডাকো। আমাদের বাড়িতে এক বয়স্ক কারিগর আসতেন। ধুতি পাঞ্জাবি পরা, হাতে চামড়ার একটা ব্যাগ। দুপুর দুপুর আসতেন। কয়েকবার আপ্রাণ চেষ্টা করে, স্কুল কামাই দিয়ে তাঁকে দেখলাম; খাটের ওপর পা তুলে বসে, একখানা দামড়া বাক্স নিয়ে তাঁর সে কী নাটা-ঝামটা! রেডিওটা এক-একবার এমন হুংকার ছাড়ত, বাড়ির লোকের ঘুম ভেঙে যেত, খাঁচার পাখি ডানা ঝাপটা দিত। হুংকার থামিয়ে সে যখন গান গেয়ে উঠত, আমরা বুঝতাম কাজ হয়ে গেছে। মা তখন হাসিমুখে তার জন্য চা-বিস্কুট, দুটো মিষ্টি, জল এনে দিত।

রেডিও বেচারা পালাপালি অতি ব্যবহারে, দুর্ব্যবহারে, ক্রমশ অসুস্থ—নিত্য রুগি হয়ে উঠছিল। এই চলতে চলতে দুম করে চোখ বোজে, এই আবার কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ চলে ওঠে। বাড়ির বিশেষজ্ঞরা হতাশ। কেউ তাকে হটানোর কথা বলছে, কেউ বলছে—ভালো করে ‘চেকাপ’ হচ্ছে না, কারিগর চলবে না। এইসব চাপানউতোর চলতে চলতে সে-ই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক বাতিল হয়ে গেলেন, আর সে-ই ফাঁকে প্রবেশ করল আমার গল্পের নায়ক—ট্যাঁপা কাকা। ট্যাঁপা কাকার বাড়ি ছিল আমাদের পাড়ার লাগোয়া। নদিয়া মিলে চাকরি করতেন আর অবসরে রেডিও সারাতেন। ট্যাঁপা কাকার খোঁজ এনেছিল ঠাকুমাই।

বাড়ির মধ্যে একমাত্র বিজ্ঞানের ছাত্র দাদা। তার কাছে আমরা নস্যি। ফিজিক্সের কীসব আজগুবি কথা শুনতাম হাঁ করে। রেডিওটার যখন মরমর দশা। সে-ই দাদাই মাঝেমধ্যে আশ্চর্য চিকিৎসা চালাত রেডিওর ওপর। সেদিন ছিল রোববার। দাদা কাচের বোতলে নুনজল ভরে একটা তারের একদিক তাতে চুবিয়ে অন্য দিকটা রেডিওর ভেতরে কোথাও আটকে দিয়ে একদিন বলল: ‘এবার দেখো, ছোলা-মটর ভাজার চড়বড় শব্দ আর থাকবে না।’ ঠাকুমা, বাবা, কাকা, পিসি সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠল। আর বুঝি কারিগরের জন্য লোকের দরজায় দরজায় ঘুরতে হবে না। ঠাকুমার মুখে একটা বিজ্ঞের ভাব ফুটে উঠেছে। নাতি-নাতনিদের সামান্য সাফল্যেও আর কিছু না হোক পারিবারিক দিক থেকে তিনি একটা নোবেল দিতেন আমাদের এবং পাড়ার কারুর সেটা জানতে বাকি থাকত না। যাই হোক, সুইচ টেপা হলো, দাদার নিশ্চিত এই আবিষ্কারের প্রতি আমাদের দৃঢ় আস্থা থাকলেও, কী একটা কারণে সবাই রেডিওর থেকে একটু তফাতে সরে দাঁড়াই। ‘কী হল!’ ভ্রূ কুঁচকে বাবা দাদার দিকে তাকায়। দু-পা এগোতে গিয়েও থমকে যাই। যন্ত্রটা যেন নাক ডাকছে! ঘর থেকে সবাই আশাহত হয়ে চলে গেলে, দাদা বলল: ‘বুঝেছি। এর একটা এরিয়াল লাগবে।’ এরিয়াল মানে? দাদার ফিজিক্সের বয়ান আমাদের কারুর মাথাতেই ঢুকল না। শেষ পর্যন্ত মানেটা ঠাকুমার ভাষাতেই পরিষ্কার হলো যে, এরিয়াল হলো গিয়ে—কথা ধরার মেশিন। এবার মনে হয় দাদার নোবেল বাঁধা! এরিয়াল এল। মেশিন-টেশিন কিছুই না, প্লেন একটা তামার ফিতের মতো জাল। নিয়ম হলো বারান্দায় টাঙিয়ে রাখা, রেডিওর সঙ্গে তার ভেতরে ভেতরে যোগ থাকবে। কিন্তু রুগির তাতে কিছুমাত্র উন্নতির লক্ষণ দেখা গেল না। বাবার গান না শুনতে পেলে এমনিই মাথার ঠিক থাকে না, তার ওপর খামোখা পয়সা নষ্ট। তিনি দু-দিন সহ্য করার পর বললেন: ‘তোমার গবেষণা এবার থামাও। যাও বা দু-একটা বুলি বেরোচ্ছে, তাও এবার বন্ধ হয়ে যাবে।’


ট্যাঁপা কাকার আবার অন্য সমস্যা। তিনি বাড়িতে আসতে পারবেন না। রেডিও তাঁর বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে। কথাটা বাড়ির কারুর মনঃপূত হয়নি। কিন্তু এই অসময়ে, দুর্দিনে, তাঁকে হাতছাড়া করাটাও বোকামি। অতএব ঠিক হলো ট্যাঁপা কাকাই হবে আমাদের রেডিওর পার্মানেন্ট ডাক্তার। দাদার ফিজিক্সের বিদ্যে কাজে না লাগলেও, একটা কায়দা বেশ লাগে-তুক-না-লাগে-তাক চালিয়ে দিতে শিখেছিলাম। সেটা হলো অবস্থা বুঝে রেডিওর মাথায়, ডান গালে, বাঁ গালে চড় কষানো। একটা না একটা কাজে আসতো। ঠাকুমা ফিক করে হেসে দিতেন। বাবার মুখ গম্ভীর থাকলেও স্বস্তির রেখে ফুটে উঠত। এইসব চলতে চলতে একদিন সে চোখ বুজল সত্যি সত্যি। আক্ষরিক অর্থে মরাকান্না বলতে যা বোঝায় তা হয়তো নয়, তবে তার চেয়ে কমও কিছু নয়। এরপর ট্যাঁপা কাকা ছাড়া আর গতি নেই। অগত্যা সে-ই প্রথম আমি আর ঠাকুমা রেডিও নিয়ে তাঁর বাড়ির দিকে এগোলাম, ঠাকুমা কাঁখে কলসি নেবার কায়দায় রেডিওটাকে নিয়ে, আমার হাত ধরে দাঁড়ালেন—ট্যাঁপা কাকার দরজায়।

মাথায় ঝাঁকড়া চুল, মোটা বেঁটে মানুষ। গোঁফ জোড়া একবার দেখলে ভোলার নয়। পরনে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি। ট্যাঁপা কাকা এসে দাঁড়ালেন। ঠকুমা রেডিওর ভারে বেঁকে গেছেন। তাড়াতাড়ি রেডিওটা ঠাকুমার হাত থেকে নিয়ে, ট্যাঁপা কাকা আমাদের ভেতরে ডাকলেন। উঠোন পেরিয়ে তাঁর রেডিও সারাবার ঘর। ‘কাল আসুন ঠিক করে রাখব।’—এ কথায় ঠাকুমার চোখ ছানাবড়া—‘সে কী! এখনই একটু দেখে দাও-না বাবা। লক্ষ্মী বাবা আমার।’ ট্যাঁপা কাকা বোধহয় এমন আবদারের মুখে কখনও পরেননি, একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। ‘না, মানে আমি তো অফিস যাব। ফিরে এসেই দেখে দেবো। সকালে, না হয় আজই রাতের দিকেই আসুন।’ ট্যাঁপা কাকার অমায়িক ব্যবহারে ঠাকুমা নিম রাজী: ‘আসলে, রেডিওটা ছাড়া সময়টা কাটবে কেমন করে বাবা?’

সেদিন রাতে যখন গেলাম, তখন রাত প্রায় ন’টা। ট্যাঁপা কাকার রেডিও সারানোর ঘরেই বসে আছি। চারপাশে ডাঁই করা রেডিও। কোনওটার কঙ্কাল বেরিয়ে আছে, কোনওটা দুটো চোখ উপরে নেওয়া অন্ধের মতো, কোনওটা আবার মুখ থুবড়ে মাটিতে। তারই মাঝখানে একটা টেবিলের ওপর আমাদের রেডিওটা। তার খোলনলচে আলাদা করে, নাড়িভুঁড়ি বার করে নিমগ্ন ট্যাঁপা কাকা কাজ করছে। ঘরে কোনও একটা রেডিও থেকে গুনগুন সুরে গান বাজছে। অত খারাপ রেডিওর মধ্যে কোথাও একটা ভালো রেডিওতে হয়তো গান হচ্ছিল। সমস্যা হলো অন্য। সে-কথা মুখ ফুটে বলাও যায় না। আমাদের রেডিওটা একেবারেই ঝরঝরে হয়ে গেছিল। তিন বেলা তাকে নিয়ে ঠাকুমা আর আমি ট্যাঁপা কাকার দুয়ারে মাথা কুটে মরি। এলাকার প্রায় সব লোকেই ঠাকুমা-নাতিকে একসাথে দেখলেই বুঝে যেত, ওই চলল রেডিও নিয়ে। প্রথম প্রথম লজ্জা করলেও পরে আর ওসব বালাই ছিল না। যদিও বাড়িতে বড় গমগমে শব্দের রেডিও থাকার জমিদারিটা আমরা বেশিদিন ভোগ করতে পারিনি। তখন সব ছোট ছোট রেডিও বাজারে আসছে, সবার হাতে হাতে রেডিও ঘুরছে। চায়ের দোকানে বাজছে। পাড়ার রিকশা স্ট্যান্ডে দেখতাম, রেডিও কোলে নিয়ে অনেকেই বসে আছে। পায়ের ওপর পা তুলে রিকশাওলারাও রেডিও শোনে! এরপর আর দেমাক মানায় না।

সেবার সবে সারিয়ে এনে রাখা হয়েছে তাকে। কোলের ছেলে, কোল থেকে নামিয়ে ঠাকুমা বোধহয় হাঁফটুকুও ছাড়েনি; ঠিক তখনই, বাবা গম্ভীর গলায় ডাক দিলেন আমাকে, ‘এটা কী সারানো হয়েছে? যেখানেই কাঁটা ঘোরাই একটাই স্টেশন!’ পরখ করে দেখি, ঠিকই তো! রেডিও তো অন্য কোনও স্টেশন চিনতেই পারছে না। যেখানেই কাঁটা লাগাই একই কথা, একই ভাষা। বাবার চোখের দিকে তাকানো যায় না, অপরাধ যেন আমারই। কাল আবার রবিবার, রেডিও না হলে বাড়িতে তুলকালাম হবে, রেডিও শুনতে শুনতে ঘাড় না নাড়ালে বাবা যে আর বাবাই থাকবে না। ঠাকুমাকে ব্যাপারটা বলতেই, প্রথমে ট্যাঁপা কাকাকে উদ্দেশ করে খানিক বিষোদ্‌গার করল। তারপর আমার পালা: ‘তুই পালের গোদা, যখন ট্যাঁপা চালিয়ে দেখাচ্ছিল, তখন কী করছিলি?’ আমি চুপ করে থাকি। আমি তো তখন গান শুনছিলাম। সে-ই মিনমিন কোরে রেডিওতে গান বাজচ্ছিল। ট্যাঁপা কাকার ঘরে গেলেই রেডিওর কথা আর মনে থাকে না। অত রেডিওর মধ্যে কোনটা বাজছে বোঝাও যায় না। ঠাকুমাও বলে: ‘ট্যাঁপার নিজের ঘরে ঠিক একখানা রেডিও চলে, সেটা কোনওদিন খারাপ হয় না।’ ঠাকুমা নিজেও চোখ বুজিয়ে গান শুনছিল। এখন সে সব কথা বাবার সামনে বলা যাবে না। বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে বললেন: ‘আমার সঙ্গে চল, আজ ট্যাঁপার একদিন কী আমার একদিন!’ বাবা রেগে গেলে ট্যাঁপা কাকার মতো এমন একটা হাতের পাঁচ চলে যাবে। সে যে কী অবস্থা হবে, সেটা বোঝার ক্ষমতা বাবার নেই। ঠাকুমার দিকে আমি তাকাই। ঠাকুমা আমার দিকে। ওই বিশাল কাঠের বাক্সটা বয়ে নিয়ে এসে কারই বা এসব ভালো লাগে! কিন্তু বাবার মেজাজকে বিশ্বাস নেই। সত্যিই ট্যাঁপা কাকা না হাতের বাইরে চলে যায়। আমতা আমতা করে ঠাকুমা বললে: ‘থাক না, কাল আমি যাবখন, সক্কাল সক্কাল গিয়ে নিয়ে আসবো।’ বাবা শোনার পাত্র নয়, ঠাকুমাকে থামিয়ে দিয়ে আমাকে বললেন: ‘চ, আমার সঙ্গে।’

ট্যাঁপা কাকার ঘরে রেডিওটা নামিয়ে দিয়ে, বাবা অপ্রত্যাশিত ঠান্ডা গলায় বললেন: “ভাই ট্যাঁপা, কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে মনে হয়। সব জায়গায় একই গান বাজছে, এইমাত্র সারিয়ে দিলে, একটু দেখো দেখি। এরকম ব্যামো আগে কখনও হয়নি!” ঘরে সে-ই মৃদু গান বাজছে। ট্যাঁপা কাকা ঘাড় ঘুরিয়ে ইশারা করে আমাদের বসতে বলল। খুব মন দিয়ে একটা রেডিওর কঙ্কাল সামনে রেখে ভাবছে। আমি গানের যন্ত্রটা খুঁজছি। এখানে এলে ওটাই আমি খুঁজে বার করার চেষ্টা করি। বাবা পাশে বসে আছেন। বুঝতে পারছি তিনিও গানটা শুনছেন। চোখটা বুজে এল বুঝি, এবার কী ঘাড় নাড়তে শুরু করবেন! কতটা সময় কেটে গেল কে জানে! দেখি, চোখ খুলে বাবা স্থির দৃষ্টিতে ট্যাঁপা কাকাকে দেখছেন। এইবার বোধহয় ধৈর্যচ্যুতি ঘটল! মগ্ন ট্যাঁপা কাকার দিকে তাকিয়ে বাবা চড়া গলায় বললেন: ‘নিজে তো নিজের গান শোনার পাকা ব্যবস্থা করে রেখেছ, তা খদ্দেরদের দিকটা তো দেখতে হয়।’ আমি প্রমাদ গুনি, হয়ে গেল আজ! কারিগরকে খেপিয়ে দিল বাবা। রেডিও তো পাবই না, উলটে কাল রবিবার। রেডিও না থাকলে বাড়ি আর বাড়ি থাকবে না! ট্যাঁপা কাকা বিনয়ের হাসি হাসছে! অতবড় অসুরের মতো গোঁফওলা মানুষের ওই রকম হাসি একবারে বেমানান। হাসিটা সারা মুখে মাখিয়ে বলল: ‘কোথায় রেডিও?’ বাবা চোখ মটকায়, ‘তাহলে গানটা কি ভূতে গাইছে?’ ট্যাঁপা কাকার সে-ই অমাইক হাসি। আমার কোনও রেডিও নেই। আমিই কাজ করতে করতে গাই একটু আধটু। বেকুবের মতো তাকিয়ে থাকি আমি। বলে কী লোকটা! হুবহু রেডিওর মতো! মাথা খারাপ নয়তো লোকটার?

বাবা কিছুক্ষণ চুপ কোরে থেকে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন: ‘তাহলে কাল থেকে প্রতি রবিবার তুমিই না হয় আমাদের বাড়িতে গিয়ে সারাদিন ধরে থাকবে, গান গাইবে। কী পারবে না?’ ট্যাঁপা কাকা কথাটা শুনে হতবাক হয়ে যায়। আমিও। এ আবার কীরকম কথা! আমি কথাটার ল্যাজামাথা কিছুই খুঁজে না পেয়ে চুপ করে যাই। বাবার মুখ দেখে বোঝাও যাচ্ছে না তিনি রেগে গেছেন নাকি রসিকতা করছেন। ট্যাঁপা কাকা কিছু একটা বলতে হয় ভেবেই বলল: ‘না, না। রাগ করবেন না, আমি এক্ষুনি দেখে দিচ্ছি।’ কথাটা বলে রেডিওটা তিনি টেবিলে তুলে নিতে যাবেন বলে উঠে দাঁড়িয়েছেন চেয়ার ছেড়ে, বাবা তখনই চিৎকার করে উঠলেন: ‘রাখো তো তোমার ওই ধ্বজামারা রেডিও, ও তুমি সময় করে সারিয়ে নিও। কালই তুমি চলে এসো আমার বাড়িতে। জমিয়ে গান হবে। খাওয়াদাওয়াও আমার ওখানেই সারবে।’



নিজের শহরে বিশ বছর বাদে ফিরে, একদিন পালবাগানের দিকে যাচ্ছি। দেখি, সাইকেলের ওপর দু-হাত ভর দিয়ে মাথা নীচু করে চোখ বুজিয়ে হাঁপাচ্ছে মানুষটা। পোশাকটা শরীরে হলহল করছে। ঝাঁটার মতো গোঁফ। এগিয়ে যাই—
—আমাকে চিনতে পারছেন?
ক্ষীণ গলায় লোকটি বলে,—নাহ্!
—এখনও রেডিও সারান?
—নাহ্!
—গান?
—নাহ্!